নিতাই ভট্টাচার্য


ছবিটা পুরোনো, বেশ পুরোনো। সেটাই যেন তিতলির বাবার সবচেয়ে দামি সম্পদ ছিল। মাঝেমধ্যে পরিষ্কার করতেন ছবিটাকে। প্রতিবছর এক বিশেষ দিনে বেলা বারোটা দশ মিনিট বাজলেই ছবির মানুষটির কপালে শ্বেতচন্দনের টিপ পরিয়ে বরণ করতেন তিতলির বাবা, এক্কেবারে ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে। যেন পরম প্রিয়জনের কপালে তিলক পরিয়ে দিচ্ছেন। এই দিনটিতে, এ-কাজে ভুল হতো না কোনোদিন তিতলির বাবার। তারপর রজনীর মালা, গোলাপের মালা আর গাঁদাফুলের মালা, এক-এক করে। গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন অন্তরের মানুষটির প্রতি। পাশে দাঁড়িয়ে শঙ্খ বাজাতো ছোট্ট তিতলি। তিতলির মা ও অনেকেই উলু দিত। পাড়ার সমস্ত ছেলেমেয়ে এসে দাঁড়াতো তিতলিদের বাড়ির উঠোনে, পবিত্র এক উৎসব যেন। তারপর সবার সামনে ছবির মানুষটাকে নিয়ে সামান্য কয়টি কথা বলতেন তিতলির বাবা। চেয়ারে রাখা ছবিটা দেখিয়ে বলতেন, "তোমরা এই মানুষটিকে ছবিতে দেখেছো। ইনি আশ্চর্য এক মানুষ, অন্য গ্রহের বলতে পারো। শুধুমাত্র কয়েকটি কথা শব্দে কবিতায় আর গানে এই মানুষটিকে বোঝা যায় না। গভীর চিন্তনশক্তি আর ভীষণ জানবার ইচ্ছে থাকলে, তবেই এই মহান মানুষটিকে..." এরপর তিতলির বাবার গলা কেঁপে উঠতো। অবাক হয়ে তিতলি দেখতো তার বাবাকে। ধীরে-ধীরে দুইচোখে জল টলটল করতো বাবার। কথা বলার মতো অবস্থায় থাকতো না। তখন কাঁপাগলায় বলতো "মামণি, তুই বল", বলে উঠোনের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকতো তিতলির বাবা। উপস্থিত সকলে অবাক হয়ে দেখতো তিতলির বাবাকে। পরিস্থিতি সামাল দিতে তখন ছবির মানুষটিকে নিয়ে দু-এক কথা বলতেই হতো তিতলিকে। সেই ছেলেবেলা থেকেই বোধহয় ছবির মানুষটিকে ঘিরে একটা ঘন অকৃত্রিম আবেগ জায়গা পেয়েছে তিতলির মনে, যা আজও অম্লান। বড়ো আপন মনে হয় মানুষটিকে, প্রাণের শক্তিও বটে। ছেলেবেলা থেকে কেমন একটা ধারণা হয়েছে তিতলির, ফটোর ওই মানুষটা তাদের পরিবারের একজন। পরম আত্মীয়।
 
তিতলির সামান্য দু-চার কথা শেষে সবাইকে মিষ্টিমুখ করানো হতো। বছরের পর বছর ধরে এমনটাই ছিল নিয়ম। বিয়ের পরেও এই দিনটাতে বাপের বাড়ি এসেছে তিতলি। বেশ কয়বছর ধরে।
বিনয় হেসে তিতলিকে বলতো, "এটা করে কী হয় তোমাদের! স্ট্রেঞ্জ, মিডল ক্লাস সেন্টিমেন্ট। যতসব বাড়াবাড়ি। দিন বদলেছে তিতলি, এসবে লোকে হাসে।" 
স্বামীর কথায় কান দিত না তিতলি। সবাইকে সবকিছু বোঝানো যায় না, উচিতও নয়। চুপ থাকতো তিতলি। সারাটাদিন বাপের বাড়ি কাটিয়ে বিকেলবেলায় ফিরে আসতো। তখন বিনয় ঠেস দিয়ে বলতো, "উদ্ধার হলো সবাই? গ্রামসুদ্ধ লোক!" 
হ্যাঁ বা না কিছু না-বলে ব্যস্ত হয়ে উঠতো তিতলি সংসারের কাজে। বুকের কষ্ট বুকেই বেঁধে রাখতো। বিনয়ের কথা যতটা না তিতলিকে আঘাত করতো, তার চেয়ে শতগুণ অপমান হতো তিতলির বাবার আর ছবির মানুষটার।
তারপর তিতলির বাবা চলে গেলেন একদিন। কিছুদিন পর মাও। চাবি পড়লো বাপের বাড়ির দোরে। এদিকে তিতলির সংসার বড়ো হয়েছে, দায়দায়িত্ব বেড়েছে। তবে ছবিটা সঙ্গে করে এনে রেখেছে শ্বশুরবাড়িতে, নিজের কাছে। এখন কোনো আড়ম্বর ছাড়াই বিশেষ দিনটাকে গভীরভাবে স্মরণ করে তিতলি। সেই ছেলেবেলার অভ্যাস। বাবার কথাগুলো কানে ভাসে। ছবির মানুষটার  দিকে চেয়ে থেকে প্রশান্তি ছেয়ে আছে তিতলির মনে।

মেয়েটা মাঝেমধ্যেই জিজ্ঞাসা করে তিতলিকে, " কারোর জন্মদিনে কান্নার কী আছে মা?"
কী করে বোঝাবে তিতলি? কান্না কি এমনি-এমনি আসে?
উত্তর দিতে পারে না তিতলি। নাকি ইচ্ছে হয় না, কে জানে! মেয়েও হয়তো বাবার মতে উল্টো-সোজা কিছু বলে বসবে, তখন খারাপ লাগবে তিতলির। কারও প্রতি অমেয় ভালোবাসা, শ্রদ্ধা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই দুইচোখ ভিজিয়ে দিয়ে যায়। সেটা জোর করে আসে না। 

আজ সকাল থেকেই মনটা ভার হয়ে আছে তিতলির, ছবির ওই মানুষটার কথা ভেবে। বিনয় জোর করে নিয়ে এসেছে পিকনিকে। তিতলি না-এলে এই বছর নাকি ভীষণ অপমানজনক পরিস্থিতিতে পড়বে বিনয়!
"বাবা আমাদের কী ভাগ্য! এইবারের পিকনিকে বিনয়দার বউ এসেছে।"  পিকনিক-স্পটে এসেই সাতসকালেই শুনিয়েছে রূপালী, অঞ্জনদার স্ত্রী।
সামান্য হেসেছিল তিতলি।
"নাও, ঠান্ডায় এলে, কফি নাও।" বলে মাধবী।
কফিতে চুমুক দিয়ে সবার পরিবারের খোঁজখবর নেয় তিতলি। কাপের কফি ফুরিয়ে আসে।
"আর একটু কফি নেবে তিতলিদি?" জিজ্ঞাসা করে পর্ণা।
" না।" ছোট্ট উত্তর দেয় তিতলি।
"কেন? ভালো হয়নি কফিটা? ওটা আমাদের পর্ণা নিজে করেছে, রান্নার ঠাকুরমশাইকে হাত দিতে দেয়নি।" বলে ছন্দা।
"না-না, তা নয়। বেশ ভালো হয়েছে।" বলে তিতলি। 
ধীরে-ধীরে জমে উঠেছে পিকনিকের ছন্দ। দুই-একজন একসুরে গান ধরেছে। বাচ্চাদের কলরব, গরম তেলে আলু ফেলার শব্দ, দূরে অন্য পিকনিক দলের শব্দদানবের চিৎকার—সব নিয়ে বেশ জমজমাট ব্যাপার একটা। সবার মাঝে থেকেও তিতলি যেন একা। জ্ঞান হবার পর থেকে আজই প্রথম এই বিশেষ দিনটা এক্কেবারে অন্যভাবে কাটাছে। ভালো লাগছে না কিছুতেই।

মনের মধ্যে আজ ছবির সেই মানুষটার ঘোরাফেরা চলতেই থাকে। ভাবনাও তাকে ঘিরেই। কী যে আছে মানুষটার দুই চোখে! গম্ভীর হয়ে আসে তিতলি। বিনয়ের অনুরোধের কাছে এমন দিনে হার মানলো, এটা ভেবে এক অদ্ভুত যন্ত্রণা অনুভব করে মনে।
"এ মা, চোখে জল কেন? শরীর খারাপ লাগছে?" তিতলিকে জিজ্ঞাসা করে পর্ণা। 
শীতের রোদ পিঠে দিয়ে পকোড়া আর কফির স্বাদ নিতে ব্যস্ত ছিল সবাই। সঙ্গে হাহা, হিহি, নানারকম মুখরোচক গল্প যেমন হয় আর কী। এমন সময় কান্নার কথা শুনে থমকে দাঁড়ায় আনন্দধারা। মহিলারা ঘিরে ধরে তিতলিকে। "কী হয়েছে?" পকোড়া খেতে গিয়ে জিভ কামড়ে ফেলেছে বলে ব্যাপারটা ম্যানেজ করে তিতলি। পরিবেশ সচল হয় আবার। আর নিজের মধ্যে ডুব দেয় তিতলি। পুরানো কথা ভাবতে-ভাবতে কখন যে ভেসে গিয়েছিল, হিসেব নেই। নিজেকে বিন্যস্ত রাখার চেষ্টা করে।

আজ বিনয়ের অফিস-পিকনিক। প্রতিবছর আজকের দিনে হইহই করে পিকনিক হয়। সবাই ফ্যামিলি নিয়ে আসে। দারুণ আয়োজন থাকে। এইবছরও সবাই সবার ফ্যমিলি নিয়ে এসেছে। গঙ্গার ধারে স্পট, সাজানো-গোছানো পার্কে। আজ প্রথম অফিস-পিকনিকে এসেছে তিতলি, আগে আসেনি কখনও। কারণ আছে। এমন দিনে পিকনিকের কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না তিতলি। বিনয় যেদিন পিকনিকে যাবার জন্য জোর করছিল, সরাসরি না করে দিয়েছিল তিতলি। "কী বলছো তুমি! এমন দিনে পিকনিকের কথা ভাবতে পারো? আমি গেছি কখনও?" বলেছিল তিতলি।
"দ্যাখো, তোমার চিন্তাভাবনায় আমি নাক গলাতে চাই না। তবে এইবারের বিষয়টা অন্যরকম। একটু সোশ্যাল হও তিতলি। আমার অফিসের ব্যাপারটা একটু বোঝো, অনুরোধ। তোমার সমস্যাটা কোথায়? যারা পিকনিকে আসছে, তারা সকলেই এডুকেটেড। তাহলে প্রবলেম কোথায়? আর পাঁচটা পিকনিকের চেয়ে এটা আলাদা। কমপ্লেটলি ডিফরেন্ট।" বলেছিল বিনয়।
খানিক চুপ থেকে বলেছিল তিতলি, "সবাই এডুকেটেড, সমস্যা সেখানেই। অশিক্ষিত লোকের অপরাধ ক্ষমা করা চলে, তাদের বোঝানো যায় আর ..." 
"মানে?"
"মানে কিছু নয়।" প্রসঙ্গের ইতি টেনেছিল তিতলি।
"তুমি না-গেলে..." অনুরোধের সুর বিনয়ের গলায়।
তিতলি না-গেলে অনেকের অনেক প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় বিনয়কে। মুখার্জিদার স্ত্রী যেমন গেলবার সবার সামনে বলেই দিল, "আসলে বিনয়দার বউ মনেই করে না আমাদের সঙ্গে ওঠাবসা যায়!"
"নিজের মেয়ে মানুষ হয়ে গেছে, এখন নিজের জগৎ নিয়েই ব্যস্ত।" বলেছিল সুদীপদার স্ত্রী ছন্দা।
"তুমি না-গেলে এইসব শুনতে হয় আমাকে। বছরের পর বছর। বোঝো না কতটা খারাপ লাগে?" বলেছিল বিনয়।
"এমন তো নয় যে আমি তোমার কলিগদের সঙ্গে কোথাও যাইনি বা যাই না? অফিস থেকে তোমরা কতবার ট্যুরের..."

প্রতিবছর বিনয়ের অফিস থেকে ট্যুরের ব্যবস্থা করা হয়। ফ্যামিলি ট্যুর। নিজেকে কখনও সেখান থেকে সরিয়ে নেয়নি তিতলি। রীতিমত আনন্দ-হইহুল্লোড় করেছে সবার সঙ্গে। সবটা মেনে নিতে না-পারলেও বুঝতে দেয়নি নিজের অপছন্দের কথা। 
"অস্বীকার করতে পারো তুমি? কিন্তু এই পিকনিকে আমার আপত্তি আছে, বিনয়। তোমাকে হাজারবার বলেছি এমন দিনে পিকনিক আমি ভাবতেই পারি না!"
"আই অ্যাডমিট দ্যাট। তুমি বেড়াতে গেছ সবার সঙ্গে। এনজয় করেছে। এভরিথিং ইজ ফাইন। বাট ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড, বড়োসাহেবের মেয়ের..."

বিনয়ের অফিসের বড়োসাহেবের মেয়ের বিয়ে হয়েছে নভেম্বর মাসে। অফিসের সবার ফ্যমিলি-সহ নিমন্ত্রণ থাকলেও, বিয়েতে উত্তরপ্রদেশ আর কে যায়? তাই এইবছরের পিকনিক স্পন্সর করছেন বড়োসাহেব। তাঁর মেয়ে-জামাই উপস্থিত থাকবে। প্রত্যেকের বাড়িতে ফোন করেছেন তিনি নিজে। তিতলিকেও অনুরোধ করেছিলেন ভদ্রলোক পিকনিকে থাকবার জন্য। "সেই জন্যই বলছি।"—বলে বিনয়।

মেয়েটা বাড়িতে ছিল সেই দিন। বলে, "কী হবে মা? যাও না একটা বছর! আশ্চর্য! অন্তত বাবার মুখ চেয়ে..." সবদিক ভেবে কিছুটা নরম হয়েছিল তিতলি।
"আমরা ওইদিকটায় ঘুরে আসি চলো। বাচ্চাগুলো এখানে খেলছে খেলুক।" বলে ছন্দা।
সায় দেয় সকলে।
"বাচ্চাদের নিয়ে নো চিন্তা। আজ রান্না, বাচ্চা নিয়ে ভাবনার ছুটি তোমাদের। যাও ঘুরে দ্যাখো সবদিক।" বলে অঞ্জনদা।
গঙ্গার ধার ঘেঁষে পা ফ্যালে তিতলিরা। নানা গল্প-হাসিঠাট্টায় ধীরপায়ে এগিয়ে চলা সবার । পিছনে হাঁটে তিতলি। দৃষ্টি ঘোরাফেরা করে চারপাশে। ওই দূরে বেলুড় মঠ। আর এপারে খানিক হাঁটলেই দক্ষিণেশ্বরের মন্দির। জায়গাটা মন্দ নয়। তবে ভাবনার স্থিরতা ঝাঁকুনি খায় অবিরাম। কত-কত মানুষজন পিকনিক করতে এসেছে গঙ্গার পাড়ে। বড়ো-বড়ো সাউন্ডসিস্টেমের শব্দ বুকের পাঁজর কাঁপিয়ে দেয়, সঙ্গে কুৎসিত নাচ। এখানে আসবার সময় গাড়ি থেকেও লক্ষ করেছে তিতলি, ফাঁকা মাঠে গান বাজিয়ে পিকনিক হচ্ছে অনেক জায়গায়। সাতসকালেই উত্তাল গানের সঙ্গে পা পড়ছে বেতালে! আশ্চর্য!

নিজেদের স্পটের দিকে হাঁটা দেয় সবাই। পুরোনো একটা প্রশ্ন মনে আসে তিতলির। আজকের দিনটাকে মানুষ পিকনিকের দিন হিসাবে বেছে নিল কেনো? অনেক ভেবেও এর কোনো সদুত্তর পায়নি তিতলি। 
রান্নাবান্না প্রায় শেষ। আর কিছুক্ষণ পরেই বাচ্চাদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হবে। "এইবার তোমরা ওদের একটু সামলাও, আমরা ঘুরে আসি।" বলে দলবেঁধে পার্কের ওই পাশে সবার চোখের আড়ালে চলে যায় পুরুষের দল। ছন্দা, পর্ণা, অদিতি, মাধবী সবাই হাসিমুখে দ্যাখে একে অপরকে। 
অদিতি বলে, "এই রসে আমরা বঞ্চিত হবো কেন?"
অদিতির কথা শুনে চমকে ওঠে তিতলি। 
"আসতে চাইলে আসতেই পারো।" মুখ না-ফিরিয়ে বলে সৃঞ্জয়দা।
" যাবি? সামান্য..." বলে অদিতি।
" বাচ্চাগুলোর কী হবে?" বলে মাধবী।
"তিতলিদি তো রইলো। ও দেখবে।" বলে পুরুষদের পিছু নিল ওরা।
আর নিঃশব্দে রক্তক্ষরণ শুরু হয় তিতলির অন্তরে। ছবির মানুষটাকে মনে পড়ে একবার। 
মাধবীর মেয়েটা বলে, "ও তিতলিমাসি, তুমি একটা গান শোনাও না। ততক্ষণে রান্নাও শেষ হয়ে যাবে।" 
কী গান গাইবে? বেশ কিছুক্ষণ ভাবে তিতলি। তারপর শুরু করে, "যদি তোর ডাক শুনে কেউ..."। 
গান শেষে দুইচোখ বন্ধ করে রাখে তিতলি, বাবাকে মনে পড়ে। বাবা থাকলে হয়তো বলতেন, "সাবাশ মামণি। আজকের দিনে এটাই সঠিক গান।"

খাওয়াদাওয়া শেষ। গোছগাছ হয়ে গেছে। যে-যার গাড়িতে উঠে বসেছে। এইবার বাড়ি ফেরবার পালা। পিছনসিটে হেলান দিয়ে ঝিমোচ্ছে বিনয়, পাশে রয়েছে তিতলি। জানালার কাঁচটা সামান্য নামিয়ে দেয় তিতলি, একটা বিশ্রী গন্ধ জমাট বেঁধেছে গাড়ির মধ্যে। এতকাল বিনয়ের সঙ্গে রয়েছে তিতলি, এই গন্ধটা অসহ্যই রয়ে গেল। জানালার ওপারে তাকিয়ে থাকে তিতলি। সকালবেলায় পিকনিক স্পটে যাবার সময় পথের ধারে যাদের অসীম উৎসাহে নাচতে দেখেছিল এই মুহূর্তে তাদের আনন্দ নিভু-নিভু। কয়েক পাত্র পানীয় ধুয়ে দিয়েছে জীবনের দুঃখকষ্ট। পরম আনন্দে ধূলায় লুটিয়ে রয়েছে তারা, গান বেজে চলেছে এখনও। 

ঘাড় ঘুরিয়ে বিনয়কে একবার দ্যাখে তিতলি। শিক্ষিত আর অশিক্ষিতের বাহ্যিক তফাতটা প্রকট হয়ে ওঠে এই মুহূর্তে।
বাড়ি ফিরে টলোমলো পায়ে নিজের ঘরে পৌঁছে কোনোরকমে জুতোজোড়া ছেড়ে, বিছানা নিয়েছে বিনয়। স্নায়ু শিথিল হয়ে এসেছে। বড়োসাহেবের ডাকে সাড়া দিয়ে পিকনিক করেছে আজ। তাছাড়া শিক্ষিত মানুষ তো, সময় মতো নরম বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে নিজেকে! নয়তো রাস্তার ওই লোকগুলোর মতোই...
ছি-ছি, ভাবতেই ঘৃণা হয় তিতলির। জানালার সামনে এসে দাঁড়ায়। 
পাড়ার ক্লাবে অনুষ্ঠান হচ্ছে। ঘর থেকে শুনতে পাচ্ছে তিতলি। মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, "আজ তেইশে জানুয়ারি, আমাদের  মহান ..."
ছবির মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকে তিতলি। এখন এই সময়ে মালা আর চন্দন দিতে ইচ্ছে যায় না, অন্তত আজকের দিনে। অপবিত্র মনে হয় নিজেকে। বাবার কথা মনে পড়ে। টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে তিতলির বাবা যেন বলছেন, "আজ তুই কিছু বল তো মামণি।" বেশ কিছুক্ষণ ছবিটার দিকে চেয়ে থেকে তিতলি। তারপর বলে  "আমি আজও বুঝে পেলাম না এমন একটা পবিত্র দিনকে আমরা পিকনিক দিবস বানিয়ে ফেললাম কীভাবে! মদ্যপ হয়ে..." কথা থেমে আসে তিতলির। ছবির মানুষটার দুটি চোখের ভাস্বর দৃষ্টির সামনে লজ্জায় কুঁকড়ে যায় তিতলি, সারা দিনের মুহূর্তগুলির কথা ভেবে। তারপর দুইহাত জোড় করে বলে, "আমাকে ক্ষমা করো হে মহামানব! তোমার কাছে..."







 



 



Comments