সমরেন্দ্র মণ্ডল

বসন্ত এসে গেছে। এসে গেছে মানে! ধুর মশাই, বসন্তর বেলা তো বেশ গড়িয়ে গেছে। আর বসন্ত মানেই "ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে"। ইস্কুলের বাংলা রচনায় বসন্ত নিয়ে সে কী কাব্য! অর্বাচীন ভাবে, সেই হাফপ্যান্ট-বয়সে বসন্ত নিয়ে এমন আদিখ্যেতা ছিল না। আর আজ দ্যাখো, পঞ্জিকার পাতায় বসন্ত জেগে উঠতে-না-উঠতেই জামাকাপড় গুছিয়ে দৌড় বীরভূম, পুরুলিয়ায়।

বসন্ত মানেই যেন পলাশ। এই পলাশ ছাড়া যেন বসন্ত হয় না। গাছের ডাল ভেঙে খোঁপায় ফুল গুঁজে সে কী আদিখ্যেতা! আহা মরি মরি! যেন জগৎ জয় করেছে।  গাছের নিচে মাটিতে শুয়ে কাতরায় ছিন্ন কচি শাখা। এইসব অর্বাচীন জানেই না, গাছের ডাল ভাঙলে গাছের ব্যথা লাগে। গাছ কাঁদে। ওরা জগদীশচন্দ্র পড়েনি।
আমি তো এক অর্বাচীন। এরা আমাকেও ছাপিয়ে যায়। আরে বাবা, গাছের নিচে যে টাটকা ফুল সক্কালবেলায় ছড়িয়ে থাকে, সেগুলো তুলেও তো খোঁপায় গোঁজা যায়। তাতে রূপের ইতরবিশেষ ঘটে না। সঙ্গে থাকে ভোরের ঘ্রাণ। কথাগুলো মুখ দিয়ে আলটপকা বেরিয়ে এল। অমনি নিকটে দাঁড়ানো সুন্দরী প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, কেন সাঁওতাল মেয়েরা যে পরে?
—হ্যাঁ পরে। তারা জানে কোন ফুল তুলতে হয়। ফুলের ভারে নুইয়ে পড়া ডাল থেকে সন্তর্পণে তুলে নেয়। গাছকে দুঃখ দেয় না, ব্যথা দেয় না।
—আপনি যে এত বড়ো-বড়ো কথা বলছেন, আপনি দেখেছেন?
—দেখেছি। আপনি কখনও সাঁওতাল গ্রামে গিয়েছেন?তাদের দাওয়ায় বসে উরুম্বা আর কালো চা খেয়েছেন? কিংবা ডিংলির ঝোল দিয়ে ভাত? চুমুক দিয়েছেন হাঁড়িয়ার বাটিতে? কথা বলেছেন সাঁওতালি কুকুরের সঙ্গে?
প্রশ্নপত্রে ১+১+১+১ প্রশ্ন পড়ে মহিলার প্রায় ভিরমি খাবার জোগাড়। ঠোঁটে শব্দ জড়িয়ে কোনোরকমে বললেন, মানে?
—মানে ওটাই। ভিতরে না-ঢুকলে জানতি পারবা না। অর্বাচীন, অর্বাচীন। জগা পাগলার চেয়েও অর্বাচীন।
ওই সুবেশী তরুণী শাড়ির আঁচল বুকের উপর টেনে ঈষৎ ভ্রূ তুলে জিজ্ঞাসা করলেন, এই যে আপনি বড়ো-বড়ো কথা বলছেন, আপনি গিয়েছেন?
—হেঁ-হেঁ-হেঁ, এই বান্দা অর্বাচীন হতে পারে, কিন্তু মিথ্যে কথা নৈব নৈব চ। শোনেন, আপনারে একটা গপ্পো শোনাই। আমাদের এক বন্ধু ছিল, মজিদ। সে এখন ওপর-জগতে নদীর ধারে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে। তা সেই মজিদ এক সন্ধ্যায় বললো, সাঁওতালপাড়ায় যাবি?
আমরা সমস্বরে বললাম, যাবো চ।
সেও এক বসন্তকাল। আকাশে ছিল চাঁদ। গাছে ছিল পলাশ। জ্যোৎস্নায় পথ চিনে এক কাঁদর পেরিয়ে পৌঁছানো গেল গ্রামে। নামে গ্রাম, আসলে পাড়া। তা গ্রামে ঢোকার মুখে দশাশই দুটো কুকুর পাহারা দিচ্ছে। আমাদের দেখেই ওরা গর্জে উঠল। আমরা তো ভয়ে সিঁটিয়ে। মজিদ  সাঁওতালি ভাষায় বেশ জোরেই ওদের কিছু বললো। ওমনি কুকুর দুটো পথের একপাশে সরে গিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলো।
পাড়ায় ঢুকে মজিদ নির্দিষ্ট বাড়িতে গিয়ে কথা বলে একই পথে বাধাহীন ফিরে আসার সময় দেখলাম, পলাশের ভারে গাছের ডাল নুইয়ে পড়েছে। ডাল ভাঙার কোনো এক্সক্লুসিভ ক্লু পেলাম না। ওরা জানে গাছের যত্ন নিতে। অনু মজিদকে জিগ্যেস করলো, কুকুর দুটোকে কী বললি রে?
মজিদ উত্তর দিল, বললাম মেহমান এসেছে। চুপ করে বসে থাকো।
—আমরাও বললাম।
—আরে, বাংলায় বললে হবে? সাঁওতালি কুকুর। ওদের ভাষা না-বললে বুঝবে ক্যানে?
আমার পাশের তরুণী তাকিয়ে আছেন থরে-থরে সাজানো ফুলের দিকে। বললাম, যাকে যেখানে মানায়। রাঙামাটির ফুল ওদের মেয়েদেরই মানায়। পাহাড়ি মেয়েদের মানায় পাহাড়ী ফুলে।
সুন্দরী ততক্ষণে গান ধরেছেন, "ও পলাশ, ও শিমুল..."।
দূরে কোথাও পাতার আড়ালে কোকিল ডাকছে। বাতাসে উড়ছে গেরুয়া ধুলো। রবিঠাকুরের 'একাকিনী' ছবির মতো তিনি দাঁড়িয়ে আছেন।

অর্বাচীন হাঁটা দেয়। ভাবে, বসন্ত এখন বাণিজ্যিক উপাদান। পলাশ, শিমুল, কুরচি, কুসুম, রুদ্রপলাশ, অশোক এগিয়ে চলেছে আন্তর্জাতিক বাজারের দিকে। শোনা যাচ্ছে বসন্তের বিলাপ।
অর্বাচীন এককভাবে দুঃখবোধে জারিত হতে থাকে। 
(চলবে)

Comments