লাল-হলুদ-কমলা রঙের ডালি সাজিয়ে সুন্দরী বাসন্তিকা নীল-পোখরাজ আকাশের তলায় পান্না-সবুজ লতার ফাঁকে যখন নিজের উপস্থিতি জানান দেয়; তখন তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে, তারও মনে মেঘ জমে আছে! প্রকৃতি তার সুখ-দুঃখের কাঁটা দিয়ে যে অনুপম নকশা ফুটিয়ে তোলে, তার নিগূঢ় অর্থ অনুধাবন করা সহজ কথা নয়! আজ সকাল থেকেই বাসন্তিকার ধূসর কেশবিন্যাস! চঞ্চলা দখিনা বাতাস তার পথ ভুলে গেছে। এলোমেলো হাওয়ায় মন উদাস করা সুরের বৈতালিকে সামনের বাড়ির বারান্দা থেকে বাগানবিলাস ঝুঁকে পড়ে চলমান রাস্তা দেখে। বাসন্তিকার পায়ের শুকনো পাতার নূপুর ঘুরতে-ঘুরতে উড়ে যাচ্ছে নিরুদ্দেশের ঠিকানায়। আশ্বিন মাসের কেটে যাওয়া দু-তিনটে ঘুড়ি, পুবালি হাওয়ায় কাঁঠালগাছের ডালে আপন মনে দোল খাচ্ছে। হু-হু করে ঢুকতে থাকা জলীয় বাষ্প একসময় ঘনীভূত হয়ে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামলো। জলনূপুরের রিনিঝিনি শব্দে শীতঘুম থেকে উঠে পড়েছে বাগানের সোনাব্যাঙ। রাস্তার ওপর ধুলোয় ঢাকা পাতাগুলো অসময়ে স্নান সেরে নিকানো মেঝের মতো এখন ঝকঝকে-তকতকে। জীবনের এই রঙবদল মনের তানপুরায় তোলে সুরের ঝংকার; অনির্বাণ প্রেমের শিখায় সেঁকে নেয় জীবন। জীবনের টুকরো-টুকরো ছেঁড়া পাতাগুলো একত্রিত করলে ফুটে ওঠে চলমান ক্যানভাস। একলা মনের কোণে সেই ক্যানভাসে রঙ-তুলির খেলায় বর্ণময় জীবনের উজ্জ্বল উপস্থিতি যেন উপল উপত্যকায় ফুটে ওঠা রক্তগোলাপ! বিষন্ন আকাশ অশ্রুপাত করার পর প্রেমের স্পর্শে ঝলমলিয়ে ওঠে। স্বয়ং মহাকাল অনন্তের পথ ধরে দিয়ে যান অপেক্ষার পত্রগুচ্ছ; দিন-রাতের বহমানতায় গড়ে তোলেন নব-নব ইতিহাস। সম্পর্কের আলো-আঁধারিতে তৃতীয় চক্ষু জন্ম দেয় চৈতন্য আর বুকের মধ্যে জাগে সামুদ্রিক বিপ্লব! যে-প্রাণ একদিন আঘাতে পাথর হয়ে গিয়েছিল; আজ তা পাহাড়ে পরিণত হয়েছে, যেখান থেকে তরঙ্গিনী আপন খেয়ালে, আপন ছন্দে নামতে-নামতে অনন্তে এসে বিলীন হয়। জীবন আর পাথর হয়ে বুকে চেপে বসে না! সাক্ষী থাকে ভোরের শুকতারা আর রাতের সন্ধ্যাতারা। ফেলে আসা ধূসর পথ আর পাতাঝরাদের মর্মব্যথা ধুইয়ে দেয় নক্ষত্রের কান্না। রাতের চিতাভস্ম মেখে শব্দবাগানে জন্মায় কথার ফুল! জ্যোৎস্না মেখে তুমুল সঙ্গমে লিপ্ত চরাচরে বসন্ত ছড়ায় পলাশের আগুন। আগুন আর বারুদের গন্ধে অতিষ্ঠ জীবন-ই পারে ছায়াপথের ব্যাকরণ ভেঙে নতুন পথের সন্ধান দিতে। মৃত্যুকে বারেবারে আলিঙ্গনের নেশায় প্রতিটি জন্মে আমি অগ্নিজিতা হতে চাই।
Comments
Post a Comment