আগে আমি কবি রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরী-র কথা অতি সংক্ষেপে বলেছি। তখন একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উল্লেখ করতে ভুলে গিয়েছি। ২০২৩-এ ছিল কবির জন্মশতবর্ষ। পশ্চিমবঙ্গের দু-একটি লিটল ম্যাগাজিন, যেমন 'চিত্রক', 'পিলসুজ', 'লেখা দিয়ে রেখাপাত' ইত্যাদি তাদের সীমিত ক্ষমতায় চমৎকার জন্মশতবর্ষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। আমার নৈহাটির বন্ধু, কবি বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী আমাকে রমেন্দ্রকুমারের বেশ কিছু কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করতে বলে। সে আরও জানায় যে, 'লেখা দিয়ে রেখাপাত' কাগজটি রমেন্দ্রকুমারের জন্মশতবর্ষ সংখ্যা প্রকাশ করবে। ওই কাগজের সম্পাদক, তরুণ কবি উজ্জ্বল গোস্বামীও আমাকে ফোন করে এ-বিষয়ে। ওই সংখ্যার অতিথি সম্পাদক বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী এবং সম্পাদক উজ্জ্বল তো আছেই। ওদের প্রস্তাবে আমি সম্মানিত বোধ করি এবং আমার পছন্দমতো রমেন্দ্রকুমারের দশটি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করি। পত্রিকায় সেগুলো যথাযথ মর্যাদায় প্রকাশিত হয় এবং পত্রিকা প্রকাশের দিন নৈহাটি রেলস্টেশন সংলগ্ন সমরেশ বসু মঞ্চে আমন্ত্রিত হয়ে আমি উপস্থিত থাকি। চমৎকার অনুষ্ঠান হয়, সেখানে দু-এককথা বলার জন্য অনুরুদ্ধ হয়ে আমি রমেন্দ্রকুমারের কাব্যকৃতি সম্পর্কে বলি। অনুষ্ঠান শেষে উজ্জ্বলের বাড়িতে রাত্রিযাপন করে, পরেরদিন দুপুরে বাদকুল্লায় ফিরে আসি। এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পেরে খুব আনন্দ পাই, কারণ রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরী এক মহান কবি; তাঁকে স্মরণ-মনন করা তো একপ্রকার তর্পণ-ই। আমার করা দশটি অনুবাদের মধ্যে 'আরশি নগর' কবিতাটি ছিল। আমি এখানে মূল কবিতা এবং আমি যে অনুবাদ করেছিলাম, তা তুলে দিচ্ছি।
আরশি নগরে এক পড়শি বসত করে।
ধান ভেসে গেছে, মানুষ মড়কে মরে।
লতাপাতা জামা, চিত্রিত দুটি ভুরু,
সূর্য হাসায় শুপুরির ফুহারাকে,
শাঁখের শব্দে আলিপুরে ফেরে হাঁস,
পড়শি আমার উঠল পন্টিয়াকে।
মনুমেন্টের নীচে
জনসভা তাকে ডাকে।
ডুবে গেছে কত শান্তির সংসার।
ত্রস্ত গরুর দুটি চোখ দ্যাখে ভয়,
ধরে আছে লোক উঁচু বাড়িটির চুড়ো,
সাহায্য দরকার।
জলে ভাসে ঘর—সান্ত্বনা দরকার।
কাপড় অন্ন নিয়ে উড়ে যায় প্লেন,
তারায়-তারায় অনন্ত শাদা রোদ,
গুনতে পারি না আর।
গণক প্রেমিক ভিক্ষুকে গুলজার
রূপসী শহর—কোথায় আরশি তার?
(আরশি নগর, ১৩৬৫)
এবার আমার ইংরেজি অনুবাদ :
The Mirror-City
A neighbour dwells in the Mirror-City.
Paddy has been washed away.
People succumb to death, thanks to pestilence.
A shirt with a design of leaves and creepers.
Eyebrows are painted and the sun makes
the fountain of areca-nut plants laugh.
Geese return to Alipore as the conches blow.
My neighbour gets board in a pontiac.
The public meeting under thr Monument
summons him.
So many people having peace once upon a time
have been ruined.
Both the eyes of the cows are so frightened.
People cling to the top of the tall building
They need rescue.
Rooms are inundated. They need solace.
Aeroplanes carrying food and clothes fly away.
Endless stars exude, as if, endless white sunbeams.
I cannot count them any more.
The beautiful city is all agog with
astrologers, lovers and beggars,
Where has it lost the mirror?
প্রিয় পাঠক, এবার রমেন্দ্রকুমারের 'জলের আয়না' কবিতাটি পড়ুন।
প্রেম যেন স্বচ্ছ এক জলের আয়না।
যা-কিছু অসম আর যা-কিছু বিকৃত করে সে সুন্দর।
যেমন আমার মুখ বাঁকাচোরা
সৃষ্টির স্বাক্ষরে
কুৎসিত,
কুটিল—তবুও জানি দীপ্ত এক যুবতীর কাছে
সেই একদিন
এই মুখ ছিল আলোছায়ার বিস্ময়
রূপের মিছিল।
এই চোখে চোখ রেখে
কোনো-একদিন
স্বপ্নে নীল
স্বপ্ন হয়ে উঠেছিল
কোনো-এক কম্পিত হৃদয়।
এবার আমার করা অনুবাদ :
Water-Mirror
Love is, as if, a crystalline water-mirror.
It transforms everything that is incongruous
and distorted into an object of beauty.
I know my face is crooked and uncouth.
Such is the curved signature of the creation.
But, yet, there was a time when this face
seemed to be a wonder of light and shade
and enormously splendid to a luminous young girl.
As she looked into my eyes, her trembling heart
turned into a dream of azure blue.
রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরী-র কবিতা অনুবাদ করা একটা চ্যালেঞ্জিং কাজ। তাঁর কবিতা দুর্বোধ্য নয়, কিন্তু দুরূহ। তাঁর কবিতা হৃদয়ঙ্গম করার জন্য পাঠককেও দীক্ষিত হতে হয়। আমি পাঠকের জন্য শুভম চক্রবর্তী-র 'রমেন্দ্রকুমারের কার্নিভাল' শীর্ষক একটি সুলিখিত প্রবন্ধের কিয়দংশ এখানে উদ্ধৃত করছি। এটা পড়লে পাঠক রমেন্দ্রকুমারের কবিতার জগতে প্রবেশ করার একটা দিশা পাবেন। শুভম চক্রবর্তী লিখেছেন—"রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরী জীবনানন্দ-উত্তর বাংলা কবিতায় যে স্বরের প্রবক্তা তা স্বীয় বৈশিষ্ট্যের স্বতন্ত্র স্বকীয়তায় উজ্জ্বল। অতীত এবং বর্তমান, ঐতিহ্য ও আধুনিক বিবিধ প্রতর্কের যুগপৎ সম্মীলন তাঁর অন্যতা ও অনন্যতাকে চিহ্নিত করে। প্রাচ্যের তৈত্তিরীয় এবং পাশ্চাত্যের প্লেটো। জমিদার এবং কৃষক। ব্রহ্ম এবং পুঁতির মউরি রমেন্দ্রকুমারের কবিতায় অনায়াস চলাচল। বৌদ্ধ দর্শনের নিস্পৃহ মহানির্বাণ বা প্রতীত্যসমুৎপাদ অথবা নিতান্ত ঘরোয়া উতরোল কিছুই কবির কবিতায় এড়িয়ে যায় না। ভারতীয় জীবনচর্চার বিবিধ প্রতর্কে তিনি লুই, কাহ্ন, ভারতচন্দ্র এবং রামপ্রসাদের উত্তরপুরুষ। তাঁর এক একটি কবিতাকে ধরে পরাবাস্তবের অনন্ত সফর করা যায়, চলে যাওয়া যায় দর্শনের বহুতলবিশিষ্ট চাতালে, ছুঁয়ে আনা যায় বেদ, তন্ত্র, লোকায়তের বহুবিধ চিন্তন প্রস্থানকে। সর্বোপরি তাঁর কবিতায় তুচ্ছ তুরীয়র সংমিশ্রণে যে অভূতপূর্ব সংবেদনের স্পর্শ পাওয়া যায় তা অনির্বচনীয়।"
কবি কমলেশ পাল-এর কথা আগেই উল্লেখ করেছি। উল্লেখ করেছি তাঁর আত্মজীবনী আমার আয়নাকথা-র কথাও। কীভাবে এই বরিষ্ঠ কবি তাঁর আত্মজীবনী শুরু করেছেন—তাঁর রচনাশৈলীর সেই স্বাদ পাঠককে কিছুটা দিতে চাই গ্রন্থটির একেবারে প্রথম পৃষ্ঠার পুরোটাই উদ্ধৃত করে।
পাখিডাকা ভোর
তারা খসবে, তারা খসবে এমন একটা ফিসফিসানি হাওয়ায় যেন চলছিল বছর আড়াই ধরে। ছেলেমানুষ, খেলায় ছিলুম, গা করিনি। ১৯৫০-এর এক মহাগ্রীষ্মের মধ্যদিনে মর্নিংস্কুল করে এসে দেখি, আমার ধ্রুবতারা মা মাটিতে শয়ান। একটু দুধ চুষবার ইচ্ছে করছিল। জনাকয় লোক ঘিরে ধরেছে মাকে, তাই মনোবাঞ্চ্ছা মনে রয়ে গেল। বাবা উঠোনে চিরদিনের মতো পঙ্গু নির্বিকার। রাগ-দুঃখ-আনন্দের অভিব্যক্তি তার নির্বিকার চুপছবি আমার স্মৃতিতে।
মায়ের স্মৃতি জ্বলছে অজয় নদীর পাড়ে। বহু তার অন্বেষণে অজয়ের পাড়ে একা একা ঘুরলাম...আলেয়ার পিছে মা মা করে ঘুরে ঘুরে আমার পড়াশুনা শেষ করে দিলাম। এরপর পরীক্ষায় শুধু চুপ করে বসে থাকা আর সাদা খাতা জমা দিয়ে আসা। বছর খানেকের মধ্যে বাবা যখন মারা গেল, আমি তখন তার কাছে নেই। আমি গেছি সিউড়িতে পরীক্ষায় আবারও সাদা খাতা জমা দিতে। সেসব চুকিয়ে ক'দিন পরে যখন চুরুলিয়া স্টেশনে এসে নামলাম, কী করে যেন কানে এল বাবা মারা গেছে দিন তিনেক হল। আমি হাউহাউ কাঁদতে কাঁদতে মাইল-দেড়েক উদোম খা-খা টাঁঢ় পেরিয়ে দেশের মুহান কলিয়ারির দাদাবৌদির আস্তানায় এলাম ক'দিন হবিষ্যান্ন খেয়ে বিতাড়িত হতে।
বাবার মৃত্যু আমাকে কাঁদিয়েছিল। কিন্তু উপলব্ধিহীন বালক আমাকে মায়ের মৃত্যু কাঁদাতে পারেনি। মনে হয়, আমার কাছে মায়ের মৃত্যুটা আদপে ঘটেইনি। আমি তো শিশুকালের বাইসারির গ্রামের বাড়িতে—মাটির দাওয়া, হোগলার বেড়া, গোলপাতার চাল—মায়ের আদর, পিটুনি, ঘরনিকানো, কড়িখেলা, মনসামঙ্গল, আলপনা...মায়ের হাজার রূপের মধ্যে আমিটি হয়ে আছি। মায়ের মৃত্যু কী, হয়তো জানিই না।"
এই হচ্ছে কবির হাতের গদ্য। প্রবলভাবে অনুভূত সুগভীর চেতনা এক-একটি শব্দ চুঁইয়ে আমাদের মগজ ও হৃদয়ে প্রবেশ করছে সাবলীল। কী প্রাঞ্জল রচনাশৈলী! মনপ্রাণ স্পর্শ করে আমাদের।
আমি নীরদচন্দ্র চৌধুরী-র আত্মজীবনী Autobiography of An Unknown Indian-এর কথা আগেই উল্লেখ করেছি। তিনি Nirad C. Chaudhuri নামেই সমধিক পরিচিত। তাঁর এই গ্রন্থের প্রথম অধ্যায় My Birthplace থেকে সামান্য একটু অংশ আমার পাঠকদের জন্য এখানে উদ্ধৃত করবো শুধু এই কথাটিই বলতে যে, সুলিখিত গদ্য তা ইংরেজিই হোক বা বাংলাই হোক, কতখানি কবিতার কাছাকাছি যেতে পারে। মেঘনা নদীর উপর রাতে নৌকোগুলো পাড়ে বাঁধা আছে। দেখুন, লেখক কীভাবে সেই নৌকোর বর্ণনা দিচ্ছেন।
"During the day the boats were a pretty and friendly sight. At night they became something more, mysterious. They themselves could be seen only as blurred masses, for their little kerosene lamps could never break up the nearly solid darkness around them, but the reflections of these lamps seemed to set the fringes of the river on fire. When the water was still, there appeared to be an illumination going on two or three feet below the surface of the water, and with breezes and ripples swaying ladders, spirals and festoons of amber-coloured light made their appearance. I was sorry to hear that thousands and thousands of these boats had been ruthlessly destroyed at the time of the Japanese invasion scare of 1942."
আমার বিশ্বাস শুধু ইংরেজি ভাষার সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্যই N.C. Chaudhuri পড়া যেতে পারে। আমাদের দেশের অনেকেই, অনেক তথাকথিত শিক্ষিত বাঙালি অহেতুক এই মহান লেখককে গালমন্দ করেন। এঁরা বলেন, এই লেখক ভারতবিদ্বেষী তথা অত্যধিক ব্রিটিশ-ভক্ত। লেখকের কোনো লেখা না-পড়েই এসব কথা বলেন এঁরা। এটা ঘটনা, বরাবরই তিনি স্পষ্টবক্তা—ঋজু ব্যক্তিত্বের মানুষ। অল ইন্ডিয়া রেডিও-তে ভাষ্যকারের কাজ করার সময়ে তাঁর একটি লেখা রেডিও-তে প্রচারিত হওয়ার পরপরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরু তাঁর উপর খুব রেগে গিয়ে তাঁর চাকরিই খেয়ে নেন। নেহরুপন্থী তারড়-তাবড় নেতা নীরদ সি-র পিছনে লাগেন। মনের দুঃখে তিনি সস্ত্রীক দেশ ছেড়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি দেন। তখন তাঁর বয়স ষাট ছুঁইছুঁই। ইংল্যান্ডে তাঁর একের পর এক বই প্রকাশিত হতে থাকে। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাগরিকত্ব প্রদান করে। অক্সফোর্ডে বসবাসের জন্য বাড়ি দেয়। ব্রিটিশ সরকারকেও নানা ইস্যুতে নীরদ সি তীব্র সমালোচনা করেছেন। কই, ব্রিটিশ সরকার তো তাঁর নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়নি, বাড়িছাড়া করেনি! শতবর্ষ উত্তীর্ণ করে নীরদ সি পরলোকগমন করেন। অসংখ্য সাহিত্য-পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর অসংখ্য গ্রন্থের পুনর্মুদ্রণের খতিয়ান দেখেই এখনও তাঁর জনপ্রিয়তা কত, তা বোঝা যায়। খুব বড়োমাপের লেখক। ইংরেজি, বাংলা—দুই ভাষাতেই দাপট লিখেছেন সারাজীবন। তাঁকে আমার গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
এবার আবার আমি কলেজ-জীবনে ফিরে যাই কিছুক্ষণের জন্য। ১৯৭১ সাল, সামনে বিএ পার্ট-ওয়ান পরীক্ষা। পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলা ঘোষণা করেছেন। 'জয় বাংলা' ধ্বনিতে ওপার বাংলা, এপার বাংলা মুখরিত। মুক্তিযোদ্ধারা লড়ছেন। পাকিস্তানের সৈন্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করছে। সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে মেরে ফেলছে, মেয়েদের ধর্ষণ করছে। বাড়িঘর লুঠ করে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে। কাতারে-কাতারে মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে এদেশে আশ্রয় নিচ্ছে। তাদের জন্য ত্রাণশিবির খোলা হয়েছে। রেশন দেওয়া হচ্ছে। ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ত্রাণের ব্যবস্থা করছেন। সরকারি কোষাগার থেকে কোটি-কোটি টাকা বরাদ্দ করা হচ্ছে। চাপটা বেশি পড়ছে পশ্চিমবঙ্গে। অসংখ্য মানুষের জন্য উপযুক্ত পরিমাণের শৌচাগার কোথায়! রাস্তাঘাট, পুকুর, নদীনালা, নয়ানজুলি নোংরা হয়ে উঠছে ক্রমশ। ব্লিচিং পাউডার ছেটালে কী হবে, দুর্গন্ধে টেকা দায়! যেন নরকে বাস করছি আমরা! ওপারে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে আমরা ৬০-৭০জন ছাত্র শুকনো খাবার, জামাকাপড়, ফার্স্ট-এইড বক্স নিয়ে গেদে পর্যন্ত ট্রেনে গিয়ে তারপর পায়ে হেঁটে দর্শনা ও চুয়াডাঙ্গায় পৌঁছে গেছি। চুয়াডাঙ্গা কুষ্টিয়া জেলায়। চুয়াডাঙ্গায় বিশাল এক আমবাগানের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে দেখা করে, ওদের হাতে ত্রাণসামগ্রী তুলে দিই আমরা। ওরা রান্না করে এতগুলো মানুষকে খিচুড়ি খেতে দেয়। তারপর আবার আমরা পায়ে হেঁটে গেদে স্টেশনে পৌঁছে রাতের ট্রেন ধরে যে-যার বাড়ি ফিরি। সে এক অভিজ্ঞতা আমার জীবনে!
আমার মামা কালীপদ বিশ্বাস ফরিদপুর জেলার বাগাটে থাকতেন। অবস্থাপন্ন কৃষক। মা-র মুখে আশৈশব কলাগাছি,বাগাট, রাজবাড়ির গল্প শুনেছি কত। মামা-র গল্পও। সেই মামা মামিমা-কে নিয়ে ছোটো-ছোটো ভাইবোনদের নিয়ে একদিন দুপুরে পোঁটলাপুঁটলি মাথায় করে আমাদের বাড়ি এলেন। আমাদের তো ভাঙাচোরা ঘর। খুবই ছোটো ঘর। সেই ঘরে, বারান্দায়, এমনকি উঠোনেও ত্রিপল টাঙিয়ে ওঁরা থাকতে শুরু করলেন। প্রথমদিকে তো ওঁদের জন্য কিছুই দেওয়া হয়নি রেশনে। মা, দিদি, দাদাবাবু খুব কষ্ট করে চাল-ডাল সংগ্রহ করে ওঁদের দু'বেলা অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা করলেন। তারপর শরণার্থীদের জন্য রেশন চালু হলে একটু সুরাহা হলো। শুধু তো মামারা নয়, দলে-দলে ওদেশের আত্মীয়স্বজন মামাদের সঙ্গে দেখা করতে আসছেন। সে এক ডামাডোল অবস্থা আর কী! কিছুদিন পরে মামারা কল্যাণী ত্রাণশিবিরে চলে যান।
এই অবস্থায় আমার পড়াশোনা তো শিকেয় উঠেছে। সরকারবাড়ির মিলুদা (দীপক সরকার) আমাকে ওঁর দোতলার ঘরের প্রশস্ত বারান্দায় পড়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। দিনে, রাতে ওখানেই পড়ি। পর্যাপ্ত আলো আছে। রাতে মিলুদা-র ঘরের মেঝেতে শুই। বাড়ি থেকে খেয়ে আসি। খবরের কাগজে পড়ছি, হাজার-হাজার বাঙালিকে হত্যা করছে পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্য। তাদের সাহায্য করছে পূর্ববাংলার-ই বিশ্বাসঘাতক রাজাকার বাহিনী। রাতে ঘুম হচ্ছে না আমার; ওইসব মৃত্যুর দৃশ্য জেগে থাকছে আমার চেতনায়, প্রায় সর্বক্ষণ। রাতে বিনিদ্র অবস্থায় থেকে-থেকে, যা-কিছু পড়ছি, ভুলে যাচ্ছি সব। অথচ সামনেই পার্ট-ওয়ান পরীক্ষা। আমার বন্ধু প্রবীর দাস-কে বললাম, "আমাকে কৃষ্ণনগরে ডাক্তার প্রসাদ মণ্ডলের কাছে নিয়ে চল, না-হলে পাগল হয়ে যাবো।" প্রবীর নিয়ে গেল আমাকে ডাক্তারবাবুর কাছে। উনি সবকিছু শুনে, দেখে ওষুধ দিলেন আমাকে। ঘুমের ওষুধও দিয়েছিলেন। ওষুধ খাওয়ার পর থেকে ধীরে-ধীরে একটু সুস্থ হয়ে উঠলাম। ঘুমও হচ্ছে। কিন্তু ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছি। পরীক্ষা শুরুর আগেরদিন দিদিকে বললাম, "আমাকে কৃষ্ণনগর কলেজের ওল্ড-হস্টেলে নিয়ে চল। ওখানে থার্ড ইয়ারের ছাত্র আনন্দদা থাকে—আনন্দ মাঝি—আমাকে ভালোবাসে খুব। ওর কাছে যাই চল, আনন্দদা নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করে দেবে।" আমি দিদির সঙ্গে দুপুর দুটো নাগাদ ওল্ড-হস্টেলে চলে গেলাম। আনন্দদা সব শুনে দিদিকে বললেন, "কোনো চিন্তা করবেন না দিদি। প্রাণেশ আমার কাছে থেকে পরীক্ষা দেবে। ওর সব দায়িত্ব আমার।" দিদি আশ্বস্ত হয়ে বাড়ি ফিরে গেল। আনন্দদা একটা চেয়ার-টেবিল নিয়ে এলেন ওঁর রুমে। আমি সেই টেবিলে বইপত্তর সব গুছিয়ে রাখলাম। আনন্দদা বললেন, "নাও আমার বিছানায় শুয়ে পড়ো। ঘুমিয়ে নাও। বিকেলে চা খেয়ে পড়াশোনা হবে।" আমি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভেঙে দেখি, সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়েছে। আনন্দদা চা-বিস্কুট নিয়ে এলেন কিচেন থেকে। হাত-মুখ ধুয়ে দু'জনে চা খেলাম। তারপর হস্টেলের সুবিশাল লনে একটু পায়চারি করে এসে পড়তে বসলাম। ফার্স্ট পেপারে তো History of English Literature আর Literary Types—রিভাইজ করে রাত দশটায় খাওয়াদাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন সকাল দশটায় পরীক্ষা শুরু। অ্যাডমিট কার্ড, পেন, বোর্ড নিয়ে চললাম পরীক্ষাকেন্দ্রে; অর্থাৎ আমার-ই কলেজের হলঘরে। আনন্দদা আমাকে হলে পৌঁছে দিয়ে হস্টেলে ফিরে গেলেন। প্রশ্নপত্র ভালোই হয়েছে। পরীক্ষা বেশ ভালোই হলো। মন থেকে ভার নেমে গেল। একটু নার্ভাস তো ছিলাম-ই, জীবনের প্রথম প্রকৃত বড়ো পরীক্ষা। তার উপরে, অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম বেশ ভালোমতোই। অনার্স ও পাস-এর সব পরীক্ষা শেষ হলে, বাড়ি ফিরলাম। দিদি অবশ্য একদিন বিকালে হস্টেলে দেখা করতে এসেছিল। মা নারকেলের নাড়ু ও মুড়ি-মুড়কির পোঁটলা পাঠিয়েছিল। আমি ও আনন্দদা ক'দিন বেশ আনন্দ করে সে-সবের সদ্ব্যবহার করলাম। অনার্স-সহ পার্ট-ওয়ান পরীক্ষা ভালোভাবেই পাস করেছিলাম। আনন্দদা-র ঋণ সারাজীবনে শোধ হবে না।
আনন্দদা নদীয়া কালেক্টরেটে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে কাজ করছিলেন তখন। আমি সাইকেল চালিয়ে স্কুল থেকে ফিরছি। স্টেশনে যাবো। হঠাৎ একটা সরকারি জিপ দাঁড়িয়ে পড়লো রাস্তার পাশে। আনন্দদা নেমে এলেন। কথা হলো। কিন্তু লক্ষ করলাম, অমন হাসিখুশি মানুষটা কেমন বিষণ্ণ হয়ে রয়েছেন। রোগাও হয়েছেন খুব। বললেন, সুগার বেড়েছে অনেক। কাজের চাপও রয়েছে, বেশ ক'টা দপ্তর সামলাতে হচ্ছে। বাড়ির খবর জিজ্ঞেস করতে বললেন, "বাবা-মা দু'জনেই গত হয়েছেন। আমাদের এক ছেলে, ক্লাস ইলেভেনে পড়ছে কলেজিয়েট স্কুলে। তোমার বৌদি হাউস-ওয়াইফ।" কিছু কথার পরে, জিপে উঠে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে বললেন, "একদিন আসবো তোমার স্কুলে।" এসেছিলেন আনন্দদা। হেডমাস্টারমশাই, শিবুদা খুব খুশি। ক্লাসগুলোতে ঘুরলেন। কীরকম পড়াশোনা হচ্ছে, জেনে নিলেন। শিবুদা প্রচুর মিষ্টি আনিয়েছিলেন ওঁর জন্য। সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলেন সে-সব। শুধু লিকার চা খেলেন, চিনি ছাড়া। তারপর চলে গেলেন। ওই আমার শেষ দেখা আনন্দদা-কে। আবাসনে যেতে বলেছিলেন, যাওয়া হয়ে ওঠেনি আমার। কিছুদিন পরে কাগজে পড়ি, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আনন্দ মাঝি আত্মহত্যা করেছেন। সুইসাইড নোটে লিখে গেছেন, "আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়"। ক'দিন পরে আমি কালেক্টরেট ভবনে গিয়েছিলাম। ওখানে আমার দু'একজন বন্ধু চাকরি করে। তারা জানালো, দাম্পত্যজীবন নাকি সুখের ছিল না আনন্দদা-র। যাইহোক, ওঁর মৃত্যু আমাকে বেশ কিছুদিন বেদনাবহ করে রেখেছিল।
(ক্রমশ)
Comments
Post a Comment