শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যে-কাজ করেছিলেন, দেশে-দেশে গিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে যে-জনমত গড়ে তুলছিলেন, বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এবং অন্যান্য দেশ (বিশেষত পাশ্চাত্যের শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহ) যাতে স্বীকৃতি দেয় তার জন্য যে-পরিশ্রম করেছিলেন—এসবের জন্য ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সে-দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান-কে ভারতে আসার আহ্বান জানান ইন্দিরা গান্ধী। তিনি এসেছিলেন এবং কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে এক ঐতিহাসিক সংবর্ধনা সভায় ভাষণ দিয়েছিলেন। রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছিল সেই ভাষণ। বাড়িতে বসেই রেডিওতে সেই ভাষণ শুনে গভীরভাবে আপ্লুত হয়েছিলাম। তারপর তো তাঁর দেশের-ই কিছু কুচক্রী সেনা অফিসার তাঁর ধানমন্ডির সরকারি বাসভবনে তাঁকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। একটি শিশুও রেহাই পায় না জল্লাদদের হাত থেকে! তারপর সেনা-অভ্যুত্থান হয় বাংলাদেশে। সেনারাই শাসনক্ষমতা দখল করে। সে এক অন্য ইতিহাস।
মহান নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা-র নেতৃত্বে ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে মুক্তি পায় দক্ষিণ আফ্রিকা। স্বাধীন সে-দেশের প্রেসিডেন্ট হয়ে ম্যান্ডেলাও কলকাতায় এসে ব্রিগেডে বক্তৃতা করেছিলেন। সেই বক্তৃতাও আমি রেডিওতে শুনি। ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে কারাগারে বন্দি ছিলেন অসাধারণ বাগ্মী এই মানুষটি। তাঁর বক্তৃতায় সেই সংগ্রামের কথা—তাঁর দেশের কথা, দেশের মানুষের কথা কী মর্মস্পর্শী ভাষায় তিনি বলছিলেন! লক্ষাধিক মানুষ ব্রিগেডের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ শোনেন—মানুষটিকে স্বচক্ষে দেখেন, কেউ-কেউ তাঁকে স্পর্শও করেন। আমার সেই সৌভাগ্য হয়নি। রেডিওতে তাঁর ভাষণ শুনে, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাই।
ব্রিটেনের রাজপরিবারের পুত্রবধূ প্রিন্সেস ডায়ানা-র গাড়ি-দুর্ঘটনায় আকস্মিক ট্র্যাজিক মৃত্যুর পরে তাঁর শবদেহ যখন বহন করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ক্রিমেটোরিয়ামে, সেই শবযাত্রার ধারাবিবরণী দিয়েছিল বিবিসি—ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন। সেই ধারাবিবরণীও আমার ভাঙাচোরা সন্তোষ ট্রানজিস্টরে, বাড়ি বসে শুনেছিলাম। সেও একটা অভিজ্ঞতা আমার কাছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষী ঔপনিবেশিক সরকার স্বাধীনতাকামী কবি বেঞ্জামিন মোলায়েজ-কে যেদিন ফাঁসি দিল, সেই ফাঁসির কথাও আমি রেডিওতে শুনি। 'শঙ্কর গুহনিয়োগী' শীর্ষক আমার একটি কবিতায় উল্লেখ করেছি সেকথা—"আমার মনে পড়ছে বেঞ্জামিন মোলায়েজের কথা / তাঁর ফাঁসির মুহূর্তে আমি সেখানে ছিলাম / আর রচনা করেছিলাম গান / যিশুকে যখন ক্রশবিদ্ধ করা হয় / আমি ছিলাম সেখানেও..."।
এইভাবে সারাজীবন ধরে ঘটে চলা নানা ঘটনার অভিঘাত কিংবা আমার জীবনে ঠিক নয়, হয়েতো-বা কিছু ঘটেছে অন্যের জীবনে, যা খুবই গেঁথে গিয়েছে আমার মনে বা সুদূর অতীতের কোনো বিষয়—যা আমি পড়েছি হয়তো কোনো গ্রন্থে অথবা দেখেছি কোনো চিত্রকলায়, ভাস্কর্যে—সবকিছুই হতে পারে আমার কবিতার এবং আমার আত্মজীবনীর বিষয়বস্তু। আমার ভ্রমণলব্ধ কত স্মৃতি—সে-সবও হতে পারে আমার লেখার কেন্দ্রবিন্দু।
আমি জীবনে বেশ কিছু জায়গায় বেড়াতে গিয়েছি—কর্নাটক, তামিলনাড়ু, কেরালা, উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাব, উত্তরাখণ্ড, ওড়িশা, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গের নানা প্রান্তে। পর্যটনের অভিজ্ঞতা থেকেও তো উঠে আসে আমার লেখা। সবচেয়ে বেশিবার গিয়েছি উত্তরাখণ্ড—ব্রহ্মপুরা গাড়োয়াল, মায়াপুরী হরিদ্বার, দ্রোণভূমি দেরাদুন, দেওদার পর্বতের মুসৌরি, ইন্দ্রপ্রস্থ নৈনিতাল, রূপকুণ্ড কৌশানি, কূর্মাচল আলমোড়া, কালদণ্ড কোটদ্বার, হৃষিকেশ নীলধারা ইত্যাদি আরও কত-কত জায়গায়। গাড়োয়াল ও কুমায়ুন অঞ্চলে ব্যাপকভাবে মনের আনন্দে ঘুরেছি। এসব জায়গায় পর্যটনের বিবরণ আমি শ্রদ্ধেয় পাঠককে অবশ্যই সবিস্তারে দিতে চাই। হিমালয়ের শিবালিক রেঞ্জের কুমায়ুন-গাড়োয়ালে ১৯৯৭ থেকে ২০১২ পর্যন্ত মোট সাতবার ভ্রমণকালে পাহাড়ে ট্রেক করেছি, তাঁবু খাটিয়ে থেকেছি, গুহার মধ্যে রাত্রিযাপন করেছি, সহজ-সরল পাহাড়ি মানুষের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মেলামেশা করেছি, গভীর পার্বত্যপথে ও অরণ্যপথে হাঁটতে-হাঁটতে নিসর্গপ্রকৃতির রূপ ও লাবণ্যে আর নিগূঢ় রহস্যময়তায় একেবারে বুঁদ হয়ে গিয়েছি।
কুমায়ুন হিমালয়ে কাঠগোদাম হয়ে নৈনিতাল, ভাওয়ালি, রানিখেত, আলমোড়া, কৌশানি, মায়াবতী, চম্পাবত আর পিথোরাগড়ে গিয়েছি একাধিকবার। বেশিদিন কাটিয়েছি নৈনিতাল, রানিখেত, আলমোড়া, কৌশানি আর মায়াবতীতে। সে-সব সুখস্বপ্নের অভিজ্ঞতা স্মৃতিতে গেঁথে আছে। গাড়োয়াল হিমালয়ে গিয়েছি হরিদ্বার, হৃষিকেশ, দেবপ্রয়াগ, নন্দপ্রয়াগ, কর্ণপ্রয়াগ, রুদ্রপ্রয়াগ, বিষ্ণুপ্রয়াগ, শ্রীনগর, পাউরি, গুপ্তকাশী, পঞ্চকেদার, ঘনা, কেদারনাথ, মধ্যমহেশ্বর, তুঙ্গনাথ, রুদ্রনাথ ও কল্পেশ্বরে। এর মধ্যে কেদারনাথ যাই দু'বার—২০০০ এবং ২০১২ সালে। ২০১৩-য় বিধ্বংসী বন্যায় ও ধসে কেদারভূমি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়, শুধু মন্দিরটি অক্ষত থাকে। ওই ধ্বংসলীলার পরে এখন তো কেদারে যাওয়ার রাস্তাটাই পাল্টে গিয়েছে। গাড়োয়ালের ত্রিযুগীনারায়ণ, উখিমঠ, বদ্রীনাথ, যমুনোত্রী, গঙ্গোত্রী, উত্তরকাশী, দেরাদুন ও মুসৌরি-তেও গিয়েছি।
এই ভ্রমণের যে-অভিজ্ঞতা এবং ভ্রমণকালে বরাবর-ই ডায়েরি লেখার আমার যে-অভ্যাস, তাতে খুব সহজেই ট্রাভেলগ লেখা যেত; কিন্তু ট্রাভেলগ আমি লিখিনি। আমার কবিতায় সে-সব অভিজ্ঞতা কোথাও-কোথাও ফুটে উঠেছে। যেমন, 'কেদারের পথে' কবিতাটি—
কেদার থেকে বাড়ি ফিরে এসে এই কবিতাটি লিখেছিলাম। সেদিন কেদারে পৌঁছে প্রথমেই মন্দির দর্শন করি, দেবতাকে দর্শন করে প্রণতি জানাই। কেদারমন্দিরের কারুকার্য, পশ্চাতে ঝলমলে কেদারশৃঙ্গ, চারপাশে বিরাজমান সৌম্য পরিবেশ দেখে একেবারে অভিভূত হয়ে পড়ি আমি। আমার সঙ্গে ছিলেন আমার অনেকদিনের ভ্রমণসাথি কৃষ্ণনগরের পুস্তক-ব্যবসায়ী ত্রিনাথ ঘোষ, ত্রিনাথদা-র বন্ধু ও বগুলা শ্রীকৃষ্ণ কলেজের গণিতের অধ্যাপক শ্রী অরুণ দাস এবং আমার ছাত্র বাদকুল্লার-ই বাসিন্দা শ্রীমান দেবাশিস সিংহ। দেবাশিস শিবস্ত্রোত্রম্ উচ্চারণ করতে-করতে বাড়ি থেকে নিয়ে আসা গব্যঘৃত, মধু, বিল্বপত্র সহকারে দেবতাকে অর্চনা করলো। সে ধার্মিক যুবক, নিয়মিত শাস্ত্রসমূহ অধ্যয়ন করে। সংস্কৃতে তার যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি, যদিও সে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর। মন্দির থেকে ফিরে একটা হোটেলে বড়ো একটা ঘরে উঠি আমরা। হাতমুখ ধুয়ে বাইরে খাবার হোটেলে ভাত খেয়ে নিয়ে মন্দিরচত্ত্বর, আদি শংকরাচার্যের সমাধিস্থল ইত্যাদি প্রদক্ষিণ করে, সন্ধ্যারতি দেখার জন্য আবার মন্দিরে যাই। সন্ধ্যারতি দর্শন করে প্রাণমন ভরে যায়। হোটেলে ফিরে কম্বলের নিচে বিশ্রাম। প্রচণ্ড ঠান্ডা! শীতবস্ত্র যা পরেছিলাম, তার সবকিছু সমেত চার-পাঁচটা কম্বলের নিচেও ঠান্ডা যাচ্ছে না কিছুতেই! খাবার হোটেলের লোক খেতে ডাকলো। টেবিলে বসে চামচ দিয়ে খাচ্ছি। ঠান্ডায় চামচ-থালায় ঠোকাঠুকি হচ্ছে আর ঠকঠক করে কেঁপে যাচ্ছে চামচ। কোনোরকমে গরম জলে হাতমুখ ধুয়ে ঘরে ফিরে কম্বলের নিচে। সকালে উঠে গরম জলে শৌচ ও স্নান সেরে, কেদারজিকে দর্শন করে গৌরীকুণ্ডের উদ্দেশে পাহাড় থেকে নিচে নামতে লাগলাম। লাঠি হাতে ধীরে-ধীরে নামতে হয়—আমাকে এক সাধু বলেছিলেন গৌরীকুণ্ডে। আমরা তাই করলাম। পথের মাঝে স্থানে-স্থানে দু-চার মিনিট দাঁড়িয়ে বিশ্রাম সেরে, আবার অগ্রসর হই। এভাবে হাঁটতে-হাঁটতে সন্ধ্যার আগে গৌরীকুণ্ডে পৌঁছে, হোটেলে ব্যাগপত্তর রেখে উষ্ণকুণ্ডে স্নান সেরে ডাল-রুটি আর কফি খেয়ে পরদিন বদ্রীনাথ যাত্রার উদ্দেশ্যে বাসের টিকিট কেটে হোটেল-রুমে পৌঁছেই কম্বলের নিচে টানটান ও ঘুম। অরুণদা মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলেন। ভোর পাঁচটায় উঠে গরম জলে শৌচ, তারপর উষ্ণকুণ্ডে স্নান সেরে প্রাতঃরাশ করে বাসে যে যার সিটে বসে পড়লাম। বদ্রীনাথের উদ্দেশে বাস কাঁটায়-কাঁটায় সাড়ে-ছ'টায় ছেড়ে দিল। পাহাড়ি পথ, বাস তার নির্দিষ্ট গতিতে এগোতে থাকলো। ড্রাইভার খুবই দক্ষ ও বিবেচক। এতগুলো তীর্থযাত্রীর জান-মাল তো তার-ই হাতে! সন্ধ্যার কিছু আগে আমরা নিরাপদে পৌঁছলাম। ৩১৩৩ মিটার উচ্চতায় ভগবান বিষ্ণুর দেবগৃহ বদ্রী বিশাল মন্দির। চারধামের এক ধাম। তুষারাচ্ছাদিত নীলকন্ঠ পর্বতের পটভূমিকায় প্রহরীর মতন দণ্ডায়মান নর ও নারায়ণ—দুই পর্বতের মাঝের উপত্যকায় ঋষিগঙ্গা ও অলকানন্দা নদীর সঙ্গমে বদ্রীনাথজি-র অপূর্ব সুন্দর মন্দির।
সেদিন বিড়লা ধর্মশালায় আশ্রয় নিই। পরের দিন সকালে গরম জলে স্নানাদি সেরে মন্দির ও দেবতা দর্শন করি। বদ্রীনাথকে দর্শন করে আমি সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করি তাঁকে, আর আমার দু'নয়ন থেকে অশ্রুবারি ঝরতে থাকে অবিরাম। সঙ্গে থাকা আমার ছাত্র শ্রীমান দেবাশিস সিংহ পরে আমাকে বলে, "স্যার, আপনি ভাগ্যবান। বহুজন্মের সুকৃতি থাকলে তবেই ভগবান বিষ্ণুর বিগ্রহ দর্শনে এভাবে অশ্রুমোচন হতে পারে কোনো মানুষের।" যাইহোক, আমি যেন খুব হালকা হয়ে যাই ওই অশ্রুমোচনের পরে! ধীরে-ধীরে আমরা নেমে আসি। রাস্তার পাশের এক দোকানে গরম-গরম রুটি ও ডাল খাই। খাওয়ার শেষে হাতমুখ ধুয়ে দোকানটির সামনে দাঁড়াতেই, অপূর্ব এক দৃশ্য দেখে জীবন ধন্য হয়ে যায় আমাদের। দেখি, নর-নারায়ণ পর্বতদ্বয়ের ঠিক মাঝখানে সূর্যের কিরণ বিশাল এক হীরকখণ্ডের ন্যায় উদ্ভাসিত হয়ে আছে। কী অপরূপ তার বর্ণচ্ছটা! মন ভরে যায় আমাদের। অরুণবাবু ক্যামেরাবন্দি করেন এই নয়নাভিরাম দৃশ্যের।
এরপর দেখি, এক মাঝবয়সী গাড়োয়ালি কাঁধে ভেড়ার লোমের অনেকগুলো চাদর নিয়ে রাস্তায় ঘুরে-ঘুরে তীর্থযাত্রীদের কাছে বিক্রি করছে। আমরা চারজনেই একটা করে চাদর কিনি তার কাছ থেকে। এক-একটা চাদর মাত্র একশো টাকা! এখনও আমি সেই চাদর ব্যবহার করি শীতকালে।
বদ্রীনাথ থেকে চলে আসি আলমোড়া। আলমোড়ার প্রাকৃতিক দৃশ্য আমাকে মুগ্ধ করে। ওখান থেকে ট্রেকারে একটা দুর্গম স্থানে এক শিবমন্দিরে যাই। গ্রামে ঢুকতেই এক থমথমে পরিবেশ চারদিকে। শুনি, দুটো অল্পবয়সী ছেলে গতকাল সকালে ভেড়া চরাতে গিয়ে আর ফেরেনি। ভেড়াগুলো সব ফিরে এসেছে; ছেলে দুটো ফেরেনি। গতকাল বিকেলে নাকি বাঘের গর্জন শোনা গিয়েছিল বেশ কয়েকবার। বাঘ শিকার ধরার পরে আনন্দে ওভাবে গর্জন করে, জিম করবেট-এর লেখা পড়ে সেকথা জেনেছি। যাইহোক, গ্রামের লোকটা দৃঢ় বিশ্বাস বাঘ ছেলেদুটোকে শিকার করেছে। আমরা মন্দির ও লিঙ্গ দর্শন সেরে ট্রেকারে আবার আলমোড়ায় ফিরে আসি। পথে দেখি, বিশাল একটি ভবন তৈরি হচ্ছে। আমাদের সহযাত্রী স্থানীয় এক শিক্ষক বললেন, বাবা আলাউদ্দিনের নামে পণ্ডিত রবিশংকর ওখানে আন্তর্জাতিক সঙ্গীতভবন প্রতিষ্ঠা করছেন। আলমোড়ায় যে-হোটেলটিতে আমরা উঠেছিলাম, সেই হোটেলের সব ঘর কাঠের তৈরি। আমরা চারজন বেশ বড়ো একটা ঘরে ছিলাম। মেঝে, বাথরুম, সব কাঠ দিয়ে তৈরি। দক্ষিণের দরজা খুলে দেখি, গভীর জঙ্গল; একদম হোটেল সংলগ্ন। তাড়াতাড়ি সে-দরজা বন্ধ করে দিই। মোমের আলোয় রাতের খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ি। ক্লান্তও ছিলাম সবাই। একেবারে সকালে উঠে দেখি, রোদ-ঝলমলে দিন। ২০০০ সালের কথা বলছি। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস।
আলমোড়া থেকে বাসে করে কৌশানি এসে পৌঁছই। এই সেই কৌশানি, মহাত্মা গান্ধী যাকে ভারতের সুইজারল্যান্ড বলেছিলেন। গান্ধীজি অনেকদিন ছিলেন এখানে। সে-স্থানের নাম এখন 'গান্ধী আশ্রম'। আলমোড়া থেকে কৌশানি ৫২ কিমি; ১৯৮০ মিটার উচ্চতায় খুবই জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র। এখানকার সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত দেখতে দেশবিদেশের পর্যটক ভিড় করে। কৌশানির সৌন্দর্য প্রকৃতই ভুবনমনমোহিনী। আমরা নির্মেঘ আকাশে তুষার আচ্ছাদিত কমেট, নন্দাঘুঁটি, ত্রিশূল, নন্দাদেবী ও নন্দাকোট গিরিশৃঙ্গের পাগল করা রূপ দেখতে পেলাম। সত্যিই, কী সৌভাগ্য আমাদের! আমরা গান্ধী আশ্রমেও অনেকটা সময় কাটিয়েছিলাম। একদিনই ছিলাম কৌশানিতে।
পরের দিন গেলাম চম্পাবত। টনকপুর-লোহাঘাট সড়কে টনকপুর থেকে সাত কিমি দূরে। চম্পাবতে প্যাগোডা-ধর্মী নাগনাথ মন্দিরের কুমায়ুনী স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন দেখে মুগ্ধ হলাম। চম্পাবত থেকে আমরা গেলাম লোহাঘাট। সেখান থেকে পরের দিন সকাল ন'টা নাগাদ রওনা হলাম মায়াবতীর অদ্বৈত আশ্রমের উদ্দেশ্যে। দু'পাশে গভীর অরণ্যের ভিতর দিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটে চলেছে গন্তব্যে। আমি ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছিলাম জানালা খুলে। ড্রাইভার জানালা বন্ধ করতে বলায় আমি তাই করলাম। সে বললো, "বাবুজি, জঙ্গল থেকে চিতাবাঘ লাফিয়ে চলন্ত গাড়ির আরোহীকে আক্রমণ করতে পারে। এই রাস্তায় বহুবার এমন ঘটনা ঘটেছে।" যাইহোক, নিরাপদেই পৌঁছলাম মায়াবতীতে। একটা টিলার উপরে রামকৃষ্ণ মিশনের আশ্রম। চারদিকে কী নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক শোভা! প্রাণমন জুড়িয়ে গেল। ঘুরে-ঘুরে দেখলাম সব। স্বামীজি যে-কক্ষে ধ্যান করতেন, সেখানেও গেলাম। আমি পদ্মাসনে বসে, ধ্যানস্থ হয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। তারপর লাইব্রেরি ও পুস্তক বিক্রয়কেন্দ্রের গেলাম। শ্যামানন্দ স্বামী (তাঁর পূর্বাশ্রম ছিল তিব্বতে) ঘুরে-ঘুরে কত গ্রন্থ দেখালেন। আমি দু-একটি গ্রন্থ সংগ্রহ করলাম। মিশনে বিরাট গোশালা রয়েছে; রয়েছে দাতব্য চিকিৎসালয়—যেখানে দরিদ্র পাহাড়ি মানুষের চিকিৎসা করেন স্বামীজিরা। সব দেখে খুব বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। চারপাশে ঘন সবুজের সমারোহ। কিছু বিদেশিকেও দেখলাম আশ্রমে। এক যুবককে তো ধ্যানকক্ষে ধ্যানরত অবস্থায়ও দেখলাম! কুমায়ুন হিমালয়ের ২০৭২ মিটার উচ্চতায় গহন আরণ্যক পরিবেশে এই আশ্রম দেওদার ও চির গাছে ঘেরা। মনে পড়ে গেল, স্বামীজির শিষ্য জ্যাভিয়ার-দম্পতির অর্থে গড়ে উঠেছিল এই নয়নমনোহর আশ্রম। 'উদ্বোধন' পত্রিকা সর্বপ্রথম এই আশ্রমের ছাপাখানা থেকেই মুদ্রিত হয়েছিল। সেই ছাপাখানাটি দেখার সৌভাগ্যও হলো আমাদের। বিকেলবেলা আমাদের সেই ভাড়া করা গাড়িতে যাত্রা শুরু করে, সন্ধ্যার শেষে লোহাঘাটে আমাদের হোটেলে ফিরে এলাম। পরদিন আমাদের গন্তব্য রানিখেত।
পরের দিন সকাল ন'টায় বাসে করে রওনা দিলাম কুমায়ুন হিমালয়ের ১৮২৯ মিটার উচ্চতায় ২১ বর্গকিমি এলাকা ঘিরে অবস্থিত, ভারতীয় সেনাবাহিনীর কুমায়ুন রেজিমেন্টের সদর দপ্তর রানিখেতের দিকে। বেলা দেড়টা নাগাদ রানিখেতে পৌঁছে প্রথমেই হোটেলে রুম বুক করে গরম জলে স্নানটান সেরে দুপুরের খাবার খেয়েই বেরিয়ে পড়লাম চারদিক ঘুরেফিরে দেখে নিতে। তুষারঢাকা হিমালয় গিরিশ্রেণির সৌন্দর্য দেখার জন্য প্রসিদ্ধ এই স্থান। এখান থেকে সোজাসুজি নীলকন্ঠ, নন্দাকোট, ত্রিশূল ও নন্দাদেবী গিরিশৃঙ্গ দেখার সৌভাগ্য হলো। এখানেই রয়েছে সবুজ ঘাসে আবৃত এশিয়া মহাদেশের সর্বোচ্চ গল্ফ গ্রাউন্ড। দুপুর গড়িয়ে বিকাল, বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা কখন এল টের-ই পেলাম না; এতটাই মগ্ন ছিলাম রানির সৌন্দর্য উপভোগ করতে। প্রচণ্ড ঠান্ডা! সাতটা নাগাদ পথের ধারে এক ধাবায় ধোসা খেয়ে হোটেলে ফিরেই তোফা ঘুম। আগামীকাল আমরা নৈনিতাল যাচ্ছি।
বলতে একটু ভুল করেছি। আসলে মায়াবতী থেকে যেদিন লোহাঘাটে ফিরে এলাম, তার পরের দিন-ই কিন্তু আমরা রানিখেতে আসিনি। সেদিন গিয়েছিলাম লোহাঘাট থেকে ৬২ কিমি দূরে ভারত-নেপাল সীমান্তে অবস্থিত পিথোরাগড়ে। পিথোরাগড়ের সৌন্দর্যের সঙ্গে কাশ্মীর উপত্যকার সৌন্দর্যের তুলনা করা হয়ে থাকে। ১৮১৫ মিটার উচ্চতায় আট কিমি দীর্ঘ পাঁচ কিমি চওড়া উপত্যকার মাঝখানে অবস্থিত অপরূপ নৈসর্গিক শোভায় মণ্ডিত পিথোরাগড়। আমরা একদিন-ই ছিলাম সেখানে। যে-হোটেলটিতে ছিলাম, তার মালিক হলেন উত্তরাখণ্ডের তদানীন্তন এক মন্ত্রী মহোদয়।
পিথোরাগড়ে বুড়ি ছুঁয়ে পরের দিন আমরা রানিখেত গিয়েছিলাম ওই লোহাঘাট হয়ে। আর রানিখেতের পরে, সকাল সাতটার বাসে চড়ে আমরা নৈনিতাল পৌঁছলাম বেলা ১২টা নাগাদ। রানিখেত থেকে নৈনিতাল ৫৫ কিমি। নৈনিতালে মোট তিনদিন ছিলাম। ১৯৩৮ মিটার উচ্চতায় পর্বত-অরণ্যে পরিবৃত নৈনিতাল আড়াই কিমি দীর্ঘ। নৈনি লেক ঘিরে ১২ বর্গকিমির এই শৈলশহর পর্যটকদের খুবই প্রিয়।
আগেই বলেছি, নৈনিতালে তিনদিন ছিলাম আমরা। পাহাড়ের গায়ে চমৎকার একটা হোটেলে ছিলাম, দোতলায়। বিশাল ঘর। দুটো ডাবল বেড। অ্যাটাচড বাথরুম। গরম জলের ব্যবস্থা ছিল। খাবার খেতাম জনৈক চ্যাটার্জিবাবুর হোটেলে। একদম বাঙালি ভোজন—ভাত, ডাল, সবজি, চারাপোনার ঝোল, আমড়ার চাটনি ও সাদা মিষ্টি দই; ইচ্ছে হলে রসগোল্লাও। দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে, পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র চাপিয়ে ম্যাল দিয়ে হাঁটতে লাগলাম আমরা চারজন। সেটাই প্রথমদিন নৈনিতালে। কালীপুজো সেদিন। চারপাশে উৎসবের আবহ। আমরা নৈনি লেক প্রদক্ষিণ করলাম। অনেকে নৌকোবিহারে বেরিয়েছে। আমরা অবশ্য নৌকো চড়িনি। সন্ধ্যা নামছে। সমস্ত জনপদ দীপাবলির আলোয় মনোরম সাজে সেজে উঠেছে। আমরা মোমবাতির প্যাকেট কিনে হোটেল 'মানস সরোবর'-এ ফিরে এসে, হোটেলের ব্যালকনিতে মোমবাতি জ্বালালাম। হোটেলের মালিক আমাদের লাড্ডু ও বরফি দিয়ে গেলেন, দীপাবলির শুভ রীতি হিসাবে। পরের দিন একটা গাড়ি ভাড়া করে দুপুরে আমরা সাইটসিয়িং-এ বেরিয়ে প্রথমেই গেলাম ভীমতাল। সেখানে বোটিং-ও করলাম। এক কিশোর নৌকোটি চালাচ্ছিল। সে বললো, "ওই দেখুন পাহাড়ের গায়ে গুহা। ওই গুহায় হিড়িম্বা রাক্ষসীকে বিয়ে করেছিল দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীম।" মিনিট ২৫ লেকের বুকে ভ্রমণ সেরে আমরা নৌকো থেকে নেমে আশপাশের আরও কয়েকটা লেক দেখলাম। তারপর গাড়ি করে গেলাম রামগড় ছাড়িয়ে এক আরণ্যক পরিবেশে দেবাদিদেব মহেশ্বরের সুবিখ্যাত শ্বেতলিঙ্গ দর্শন করতে। অপূর্ব লিঙ্গ! প্রাণ জুড়িয়ে গেল দর্শনে। মন্দিরচত্ত্বরে এক মৌনী সাধুকে দেখলাম। দেবাশিস সাধুর কাছে গিয়ে বসলো কিছুক্ষণ।
এরপর নৈনিতালে ফিরে আসার জন্য রওনা দিলাম। রামগড় (এখানে রবীন্দ্রনাথ অনেকদিন ছিলেন) ছাড়িয়ে কিছুদূর এসে আমার গাড়ির যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়লো। ড্রাইভার যুবকটি একঘন্টার চেষ্টায় গাড়িটিকে চলার মতো অবস্থায় নিয়ে এল। সে যখন গাড়ি সারানোয় ব্যস্ত ছিল, আমরা রাস্তার ধারে একটি দোকানে চা খেলাম। দোকানি বললো, "আপনারা পাতাভাজি খাবেন?" আমরা পাতাভাজি কী, তা জানতাম না। কৌতূহল থেকে বললাম, "ঠিক আছে, খাওয়া যাক।" লোকটি দোকানের পিছনে গিয়ে একটু নেমে তেঁতুলপাতার মতো কিছুটা দেখতে ছোটো-ছোটো পাতা সংগ্রহ করে এনে, দোকানে জল দিয়ে ভালো করে ধুয়ে নিল। তারপর বেসন ফেটিয়ে, তা দিয়ে পাতাগুলো মেখে গরম তেলে ভেজে আমাদের শালপাতায় করে খেতে দিল। অতি সুস্বাদু সেই পাতাভাজি খেয়ে আবারও চা খেলাম। গাড়ির চালক ছেলেটিও খেল। তারপর দোকানিকে দাম মিটিয়ে বসে আছি আমরা। গাড়ি মেরামতের কাজও চলছে ওদিকে। হঠাৎ লক্ষ করি, দোকানির ছেলে একটা বালতি নিয়ে তরতর করে নিচে নেমে গিয়ে একটা ঝর্না থেকে জল ভরে নিয়ে এল। বিস্মিত হয়ে দেখছিলাম, কী ক্ষিপ্রতায় ছেলেটি নিচে নামলো এবং উঠে এল। দৃশ্যটি সহজে ভোলার নয়।
যাইহোক, গাড়ি সারানো হয়েছে। এবার আমরা নৈনিতালের উদ্দেশে রওনা হলাম। গাড়ির ভাড়া মিটিয়ে রাস্তার পাশের ধাবায় চা-পকোড়া খেয়ে হোটেলে পৌঁছে গরম জলে হাত-পা ধুয়ে, ব্যালকনিতে এসে বসলাম পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র গায়ে চাপিয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ত্রিনাথদা বললেন, "চলুন, রাতের খাবার সেরে নিই; প্রচণ্ড ঠান্ডা!" আমরা চারজন বাইরে বেরিয়ে রুটি ও চিকেন কষা দিয়ে নৈশ-আহার সেরে হোটেলরুমে ফিরে, সবাই মিলে গল্পগাছা শুরু করলাম। রাত সাড়ে-ন'টায় যে যার রুমে কম্বলের নিচে চলে গেলাম। আমি ও দেবাশিস কথা বলতে-বলতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম! পরের দিন সকল আটটা নাগাদ হোটেলে নিচেই এক নেপালি যুবকের দোকানে বড়ো গ্লাসে চা খেতে-খেতে, এক ব্রিটিশ তরুণের সঙ্গে আলাপ হলো। ছেলেটি এডিনবরা থেকে পদার্থবিদ্যায় সাম্মানিক স্নাতক। তার নেশা হলো পাখি দেখা। অ্যামেচার অর্নিথোলজিস্ট সে। আমাকে তার ক্যামেরায় প্রচুর হিমালয়ান বার্ডের ছবি দেখালো। এর মধ্যে বেশ কিছু পাখি আমরা কৌশানি, আলমোড়া ও রানিখেতে দেখে এসেছি। ছেলেটি কথা বলতে-বলতে একের পর এক গ্লাসে করে দুধ-চা খেয়ে যাচ্ছিল। নেপালি তরুণটি পরে আমাকে বলেছিল, "সাহেব সকালে আমার দোকানে মোট দশ গ্লাস চা খায়। সারাদিন আর কিছু খায় না। সন্ধ্যায় ফিরে নৈশভোজ সারে।" সত্যি, ব্রিটিশ যুবকটির সঙ্গে কথা বলে বেশ আনন্দ হলো আমার।
এদিন নৈনিতালে আমাদের তৃতীয় বা শেষদিন। সারাদিন আমরা পায়ে হেঁটে উপত্যকাটি ঘুরে দেখলাম। নৈনি লেকের পাশে গিয়ে বসে থাকলাম। সারাদিন ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যার আগেই হোটেলে ফিরে, গরম জলে হাতমুখ ধুয়ে হোটেলের রুম-বয়কে দিয়ে রুটি-তড়কা ও কফি আনিয়ে খেয়ে নিয়ে বিশ্রাম নিতে থাকলাম। পরের দিন আমরা কাঠগোদাম রেল স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে বেনারস যাবো।
কাঠগোদাম স্টেশনটি খুব সুন্দর। পাশেই পাহাড়; স্টেশন থেকে দেখা যায়। নির্দিষ্ট সময় থেকে প্রায় দু'ঘন্টা দেরি করে ট্রেন এসে পৌঁছলো। আমরা আমাদের সংরক্ষিত কামরায় উঠে আমাদের সিটে গুছিয়ে বসলাম। ট্রেন ভালোই দৌড়চ্ছে; ঠিক সময়েই বারাণসী পৌঁছলাম। সন্ধ্যাবেলা। শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বিড়লা অতিথিশালায় গিয়ে উঠলাম আমরা। ব্যাগপত্তর রেখে, হাতমুখ ধুয়ে, বেরিয়ে পড়লাম। সোজা পৌঁছে গেলাম গঙ্গার দশাশ্বমেধ ঘাটে। ততক্ষণে গঙ্গারতি হয়ে গেছে। আমরা হেঁটে-হেঁটে মণিকর্ণিকা, রাজা হরিশ্চন্দ্র ঘাট, কেদারঘাট ইত্যাদি বেড়ালাম। বারাণসীতে গঙ্গার ঘাট থেকে ঘাটে ঘুরে বেড়ানোর মজাই আলাদা। গঙ্গাবক্ষে অসংখ্য নৌকো ভেসে চলেছে। গঙ্গাবক্ষে জ্বলন্ত প্রদীপ ভাসছে। সে এক অনুপম সৌন্দর্য! মণিকর্ণিকা ঘাটে শবদেহ দাহ হচ্ছে দেখলাম। মণিকর্ণিকায় চিতা কখনও নেভে না।
বারাণসীতে এ-পর্যন্ত পাঁচবার এসেছি আমি। বারাণসী প্রতিবার-ই আমার অন্তরাত্মায় একটি ছোটো প্রদীপ জ্বেলে দিয়েছে—এমনটাই মনে হয়েছে আমার। এবার দশাশ্বমেধ ঘাটে এক তরুণের সঙ্গে পরিচয় হলো; সে পরম আদরে আমাকে তার ঘাট-সন্নিহিত ডেরায় নিয়ে গেল। বসার ঘরটিতে ঢুকেই দেখি, প্রচুর আড়বাঁশি; রাধাকৃষ্ণ, শিব-পার্বতীর বড়ো প্রতিকৃতি। আর আছে পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার এক সুবিশাল প্রতিকৃতি। তরুণটি জানালো, পণ্ডিত চৌরাসিয়া তার গুরু; তাঁর কাছেই সে বাঁশি বাজানোর পাঠ নিয়েছে। আমি তরুণটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে ধীরে-ধীরে গোধুলিয়ার দিকে হাঁটতে লাগলাম। তরুণটির বিনয় আমাকে মুগ্ধ করেছে। আবার যদি বারাণসী যাই কোনোদিন, তার সঙ্গে অবশ্যই দেখা করবো আমি; যদি অবশ্য ওই ডেরাতেই সে থাকে তখনও।
বারাণসীর গঙ্গার ঘাট থেকে সকালে স্নান সেরে বেরিয়েই আমরা কচুরি, আলুর তরকারি ও রাবড়ি সহযোগে প্রাতঃরাশ সারতাম। ওখানকার রাবড়ি, কচুরি ও জিলিপির কোনো তুলনা হয় না। সকালে এই প্রাতঃরাশের পরে বেলা দুটোর আগে খিদেই পাবে না। দুপুরেও আমরা নিরামিষ খেতাম। সরু চালের গরম ভাত, গব্যঘৃত, মুগের ডাল, আলুভাজা, ধোঁকার ডালনা, আমের চাটনি, পাঁপড়ভাজা, মিষ্টি সাদা দই। অমৃত সেই মধ্যাহ্নভোজ। মা অন্নপূর্ণার অশেষ কৃপার জন্যই আমাদের সেই অমৃত জুটতো বিড়লা অতিথিশালায়।
প্রায় আড়াইদিন কাশীধামে থেকে বিশ্বনাথ দর্শন করে, মা অন্নপূর্ণাকে দর্শন করে বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরেছিলাম সেবার। হাওড়ায় না-ফিরে, বর্ধমান স্টেশনে নেমে, সেখান থেকে বাস ধরে কৃষ্ণনগর। তারপর আমি আমার বাড়ি, বাদকুল্লায়।
সম্পাদকীয় সংযোজন : তাঁর ঘটনাবহুল জীবনবর্ণনার এই কুড়িটি পর্ব একটানা লিখে, কবি প্রাণেশ সরকার সামান্য বিরতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিছুদিন পরে তিনি মুক্তধারা অনলাইন-এ আবার লিখতে শুরু করবেন তাঁর আত্মজীবনীর বাকি অংশ।
★★ এখানে 'কেদারের পথে ' কবিতাটি কবির হস্তাক্ষরে, এই আত্মজীবনীর পাণ্ডুলিপি থেকে সরাসরি ছবি তুলে দেওয়া হয়েছে।
Comments
Post a Comment