একজন কলের মিস্তিরিকে ঠিক কতটুকু জানতে হয় বলুন তো? আপনি বলবেন পাইপলাইন, পাম্প, ভালভ, জলের ফ্লো, ওয়েল্ডিং ইত্যাদি। তারপর বলবেন স্মার্ট রেঞ্জ, স্ক্রু ড্রাইভার এবং টেপের ব্যবহার। খুব সৃষ্টিশীল অথবা বিশ্লেষণধর্মী হলে বলতে পারেন, একজন কলের মিস্তিরিকে জানতে হবে কীভাবে প্রয়োজনে সরীসৃপের মতো চলতে হয় দেওয়াল এবং নলের ভিতরে; কীভাবে বর্জ্য এবং পুঁতিগন্ধ এড়িয়ে স্বচ্ছতার কথা বলতে হয়। তবু আমি আরও কিছু শুনতে চাইবো এবং একজন কলের মিস্তিরিকে প্রোটাগনিস্ট তৈরি করার আগে আমি জানতে চাইবো আপনার যাবতীয় সংগ্রহ। তাকিয়ে থাকবো আপনার দিকে। প্রত্যাশা করবো আপনি আরও কিছু বলবেন। এবং আমি জানি, আপনি আরও অনেক সংগৃহীত বুলেট পয়েন্ট বলতেও পারেন অথবা নাও বলতে পারেন। আপনার বলতে পারাটা সংখ্যাগরিষ্ঠের দলে আপনাকে নথিভুক্ত করার প্রচেষ্টা এবং না-বলতে চেয়ে এড়িয়ে যাওয়াটা বুদ্ধিজীবীর স্তরে উন্নীত হওয়ার প্রবণতা।
কিন্তু তবুও আমি নিশ্চিত, আপনি সেই কথাটা কিছুতেই বলবেন না যে-কথাটা আমি শুনতে চাই। আপনি ভেবে অথবা না-ভেবেই হয়তো পাইপের কথা বলবেন, ফিটিংসের কথা বলবেন, আটকে যাওয়া কলের মুখ পরিষ্কার করার নতুন প্রযুক্তির কথা বলবেন, এলবো জয়েন্টের কথা বলবেন, সুইচ এবং কানেকশনের কথা বলবেন এবং অভিজ্ঞতা কিছু বেশি আছে প্রমাণ করতে সার্কিট বোর্ড পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারেন অনায়াসে। কিন্তু সার্বিক জটিলতাকে অস্বীকার করে আপনি কিছুতেই বলবেন না যে, একজন কলের মিস্তিরিকে শুধুমাত্র জলের বিষয়ে জানলেই চলে। তাকে শুধুমাত্র জানতে হয় জলের চাপ এবং তার গতি সম্পর্কে। গভীর জলের ষড়যন্ত্রের কথা জানতে হয়। জানতে হয় জলের ভিতরে কীভাবে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে মৌলবন্ধন। আপনি বলবেন না কারণ, জল কীভাবে আপনার ব্যবহারের প্রতি ক্রিয়াশীল সে-কথা আপনি ভাবেন না। আমি শুরু থেকেই একথা জানতাম। প্রথমে আমি ভাবতাম, জল সম্পর্কে জানতে হলে একজন কলের মিস্তিরি হওয়া খুব দরকার। তারপরে জানলাম, কল সম্পর্কে জানতে হলে জলকে জানা দরকার। কীভাবে নিচুপথ থেকে উঁচুপথে জলের যাতায়াত চলে, কীভাবে তার চাপ বেড়ে ওঠে অন্ধ পাইপের গলার ভিতরে, কীভাবে সে পলি জমা করে দেহের ভিতরে, কীভাবে অদ্রবনীয় অবশেষে আটকে যায় আর সরু হয়ে রক্তের মতো চুঁয়ে পড়ে যায়।
আচ্ছা আপনি জলের যন্ত্রণা বোঝেন? প্রেম? শরীর? নির্ঘাত বোঝেন না। কারণ আপনি একজন সার্থক কলের মিস্তিরি নন। আপনি একটি চলমান নির্দেশিকা, আপনি একটি অ্যারো, একটি টিকচিহ্ন অথবা আপনি নিছক একটি বিধিবদ্ধ প্রক্রিয়া। আপনার প্রাণ নেই, প্রাণের নাদ নেই, ধ্বনি নেই, ত্বরণ নেই, আপনার উৎসেচক বা অনুঘটক—কোনোটিই নেই। আপনি একটি সরল তত্ত্বাবধান মাত্র।
আমি কিন্তু জানতাম, আমি আপনি নই। আমি জানতাম, আমি তরলের দুঃখ বুঝি। তার শরীর চিনি। আমি জানি তরল কীভাবে জল হয়ে যায়। আমি জানি রক্ত এবং জলের মিলমিশ। জানি কীভাবে শুষে নেওয়া হয় অবদান। কীভাবে শরীরের কফ, থুতু, লালা এবং মলমূত্রের দুঃখ বয়ে নেয় তরল প্রবাহ। তারপর ক্লান্তি ধুয়ে ফেলে পৃথার স্থূলকায়া শরীরে। শাওয়ার থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে মসৃণ কাঁধের উপরে। সাবান পিছলে যায়। অখণ্ডের খণ্ডিত রূপ। প্রবাহের ভাঙন। অসংখ্য জলবিন্দু থেকে ন্যূনতম এক ফোঁটা অণুবিন্দু—সকলই জীবিত, সকলই জন্ম দিতে চায় নতুন আধার। গলা বেয়ে দ্রুত নিচে নেমে স্পন্দিত হয়। প্রাণবন্ত যৌনতা দেবী হয়ে ওঠে। তরলে তরল মিশে সবটুকু শুধু জল। শুধু সেই জলের ভিতরে জেগে থাকে ঈশ্বরের স্নান। সেই জল, সেই স্নান, সেই ঈশ্বর বয়ে যায় নালিপথে। সে-পথে জমে যায় শতপদীর জন্ম এবং গোপন বিস্তার, সুড়ঙ্গ, হুল এবং দাঁড়। সে-পথে কিলবিল করে জীবাণু, সে-পথে গভীর গোপন ফেনা ফুলেফেঁপে বন্ধ করে দেয় নির্গমণ।
বিপ্লব একাধারে উচ্চবর্গীয় এবং নিম্নবর্গীয়। নিয়ন্ত্রণ চিরকাল অমার্জিত, শক্তিশালী, হোসপাইপের স্রোতের মতো ধারালো। যা-কিছু ঘৃণিত, যা-কিছু অসহনীয়, যা-কিছু বর্জ্য, তার সবটুকু শুধু ওই জল। যাকে চিকন অন্ধকার ঠেলে এগোতে হবে অনন্ত অন্ধকার কোনো কুয়োয়। ঠিক যেভাবে কমিউনিজম টিকেছিল সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পরে, সেভাবেই কর্তিত ছাল আর মাংসগন্ধ সমেত জল গড়িয়ে যায় নালার ভিতরে। তারপরে ওই সিলিনড্রিকাল পাইপের ভিতরে তার দুরূহ কঠিন চলাচল। ধারকের আকার, অস্তিত্ব ধারণ করে শাসকের নির্দেশনা মেনে চলার বাধ্যবাধকতা। প্রকৃতও ঢাল দেখে। দেখে ভূমিরূপ। আধার দেখে, আয়তন দেখে। আপেক্ষিক করে তোলে নিজেকে।
একসময় আলো ফোটে। সূর্যোদয়! সবুজ! বন্ধনহীন প্রাকৃতিক বাতাস এবং দেওয়ালহীনতা। সাবেক পোকাদের তেষ্টা নিবারণ এবং প্রজাপতির বালখিল্য স্নান। আপনাকে ঠিক এই সময়ে আমি ডাকি। আপনি ভোক্তা আমি ভোগ। আপনি কর্মক্ষেত্র আমি কর্মকুশলতা। কল ছেড়ে দিয়ে দেখে নিতে বলি জলের স্পর্ধা। শাওয়ার খুলে দিই, সিস্টার্ন ফ্লাশ করি, গিজার অন করে দিই। আপনি তাকিয়ে থাকেন জলের গড়িয়ে পড়ার দিকে। প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে আপনার মুখে। দু'হাত দিয়ে চুলের গোছা সরিয়ে ক্লাচার খুলে ফের লাগান। ডানহাতের তর্জনীর উল্টো পিঠ দিয়ে নাক ঘষে নেন আনমনে। আপনার মসৃণ চিবুকে জলের ছিটে লাগে। আমি মনে-মনে আপনাকে সম্বোধন করে লিখে যাই জলের কবিতা। কল বন্ধ করি, সংহত হয় জলজ বেয়াদপি।
বাহ্ খুব ভালো লেখা
ReplyDeleteবেশ ভালো
ReplyDelete