রীনা ভৌমিক

তোমার একটা নাম রাখলাম। অবেলার গান। এই মুহূর্তে কর্মে ও বর্মে আমি নিজেকে মধ্য-চল্লিশের পূর্ণতায় খুঁজে পেয়েছি। ভেতরে যে-জোয়ার এসেছে, তার ঢলান জৈবিক থেকে অলৌকিকে! ভাবছো, কেন তোমাকে এসব শোনানো? আসলে তুমি আমার জীবন-স্টেশনের শেষ ট্রেন গো, বড়ো আদরের! এরপর একঝাঁক অন্ধকার এসে আমায় নিভিয়ে দিয়ে যাবে। আগামী দিনে যে-সূর্য উঠবে, যে-পাখি গাইবে, যে-স্টেশন জেগে উঠবে এখানে, সেখানে অন্য এক নতুন গল্প ধীরলয়ে দানা বাঁধবে। এভাবেই বিগতকে আগতের জন্য জায়গা করে দিতে হয়। 

তোমাকে একটা গল্প বলি। এই স্টেশনের শেষপ্রান্তে যে-কদমগাছটা, যার ছায়ায় সিমেন্টের বেঞ্চে যাত্রীরা ট্রেনের অপেক্ষায় জিরোয়, ক'দিন আগে একটা বসন্তবৌরি পাখি বাসা বেঁধেছিল সেই গাছের কোটরে। দুটি ডিম সাথে এনেছিল সঙ্গী পুরুষটি ছাড়াই। বসন্তবৌরি! বৌরি হলো অল্পবয়সী বধূ। মাতাল বসন্ত! আহা কী রূপ! লালে হলুদে ঝলমলে সবুজে টুকটুক ডাকে। সেই অনুরণনে কদমগাছের রোমে-রোমে অভূতপূর্ব পত্রোদ্গম হলো। তার সেই মুহূর্তের অনুভূতির কথা বলেছিল সে এভাবেই, জীবনটা গমগম করছে এসরাজের সুরে!  তারপর অনিবার্য, একদিন পাখি উড়ে গেল। বৃক্ষটির বুকে নাকি সমুদ্র ঘাই মারে আজকাল! সমস্ত সবুজ সমুদ্রের নোনাজলে ভাসানের গান শোনে। 

তোমার স্পর্শটুকু আত্মজীবনীর পাতায় রেখে যাই। বৃক্ষ জানে না, আমি জানি, নদী তার উৎসে ফেরে না কখনও! বুঝি না, ভালোবাসলে প্রাণ এত কাঙালিপনা করে কেন? মাত্র ক'টি আঙুলের স্পর্শ, অনুভূতি ভূমিকম্পে কেঁপেছিল সময়ের ন্যানো-মুহূর্তে । জেনেছি তো, ওটুকুই গন্তব্য। ওটুকুই অভিমান। শরীর একটা পাত্র ব‌ই তো নয়। আত্মার আত্মীয় খুঁজে পেতে শরীরের পথেই তো যেতে হয়। 

শুনেছি, দাতার চেয়ে শ্রেষ্ঠ নাকি গ্রহীতা। গ্রহণ উদাত্ত হলে দানের মহত্ত্ব বেড়ে যায়। হঠাৎই আমার ভাইভ তোমার ভাইভ-কে স্পর্শ করেছিল, যেভাবে দুটো উল্কাপিণ্ড আঙ্কিক বেনিয়মে কখনোসখনো কাছাকাছি এসে পড়ে। তারপর আবার যে-যার কক্ষপথে! মুহূর্তকে ছোটো করে দেখার কিসসু নেই। আসল খেলা তো মুহূর্ত‌ই খেলে। যেভাবে অনন্ত থেকে জেগে উঠেছিল বিগ ব্যাং...অথই জলরাশি থেকে ওঙ্কার! ঘটনা ওটুকুই ছিল, কামাল তো হয়েছিল তারপর। 

কামালনামা লিখে যাই। দুটো উল্কাপিণ্ড পরস্পর স্পর্শকবিন্দু স্পর্শ করেও ভষ্ম হলো না আদৌ। অথচ যা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তা না-হয়ে, যে-যার কক্ষে ফিরে যেতে-যেতে অভাবিত পুনর্জন্মবোধে তরতাজা হয়ে উঠলো!

Comments

Post a Comment