সমরেন্দ্র মণ্ডল

"...সেদিন চৈত্রমাস– / তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।।"

দেওয়ালে ঝোলানো দিনপঞ্জির পাতায় চোখ মেলতেই পংক্তিটা খটাস করে মাথায় গাট্টা মারলো। অর্বাচীন ভেবে পেল না, কবি কার চোখে সর্বনাশ দেখেছিলেন। সে ভাবতে বসলো, চৈত্রমাস মানেই তো গরমে বেগুনভাজা হয়ে যাওয়া। চৈত্র মানেই তো বৃষ্টি নেই, শুধু মেঘ ডাকা। দুড়ুম-দাড়াম গদাম-গদাম কড়কড়-ক্কড়াৎ। চোখ ঝলসে বাজ পড়ছে। পড়ছে তো পড়ছেই, আর থামে না।

ধু-উ-র-র-র ভাল্লাগে না।
অর্বাচীন যখন ভাবছে, ভাবছে আর বিরক্ত হচ্ছে, বিরক্ত হচ্ছে আর চৈত্রমাসটার ওপর খেপচুরিয়াস হয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনই কোত্থেকে জগা পাগলা এসে হাজির। পিছন থেকে চটাস করে মাথায় একটা চাঁটি মেরে বললো, কী রে চোত পাগল—
—কে মারল রে শা—
ঘুরতে গিয়েই দ্যাখে জগা পাগলা সামনে এসে হাজির।বললো, কেমন দিলুম? এই গরমেই পাগল?
—আমি পাগল না তুই পাগল?
হেঁ-হেঁ করে হেসে জগা বলে, আমি তো পাগলই। জগা পাগলা।  তুইও পাগল। পাগল না চৈত মাস চৈত মাস করে হেদিয়ে মরে? আরে বাবা ক'দিন পরেই তো বোশেখ আসছে। "এসো হে বৈশাখ এসো এসো"।
অর্বাচীন চোখ মেলে জগাকে দ্যাখে। ওর চুলভর্তি রুপোর তার জড়ানো। জগা এখন ভাবতে পারে। সে ভাবলো, জগা পারে আর আমি পারিনে! নিজের বুকে দুম করে একটা কিল মারলো। আর তখনই দেখে, জগা ভুল উ উ স।
অর্বাচীন এবার ভাবতে বসলে। বোশেখ মানে...পাড়ার শম্ভু মুদির দোকানে পঞ্চাশ নয়াপয়সার তেল আর পাঁচ নয়াপয়সার হলুদ কিনতে গেলে লালকালিতে ছাপা একটা কার্ড ধরিয়ে দিতেন। বলতেন, মাকে দিও। আর তোমরা দুই ভাই এসো।
বাড়িতে এসে মায়ের হাতে কার্ড দিয়ে অর্বাচীন বলতো, হালখাতার নেমন্তন্ন।
মা কার্ড নিয়ে রেখে দিত। শুধু শম্ভু মুদি নয়, আরও ক'টা নিমন্ত্রণপত্র জমা হতো বাড়িতে। সবই প্রায় একইরকম লেখা। উনিশ আর বিশ। লাল কার্ডে লাল অথবা সবুজ কালিতে ছাপা। বড়ো হয়ে অর্বাচীন জেনেছে, বড়বাজার থেকে শ'-দরে  চাল-ডাল-তেল-নুনের সঙ্গে কার্ড কিনে আনতো দোকানিরা।
তা সেই হাফপ্যান্ট বয়সে অর্বাচীনের দৌড় ছিল ওই শম্ভু মুদির দোকান পর্যন্ত। দাদা যেত অন‌্য দোকানে। পয়লা বোশেখের বিকেল হলেই মনটা আনচান করতো। কতক্ষণে মা বলবে, যা, ঘুরে আয়।
অবশেষে রোদ পড়লেই সুতির হাফপ্যান্ট আর ছিটের শার্ট  পরে ঘোড়াপায়ে শম্ভু মুদির দোকান। সঙ্গে যেত ছোটো ভাই। ভিতর-বাইরে কলি ফেরানো দোকান থেকে একটা গন্ধ ভেসে আসতো। গন্ধটা ঠিক কীরকম, অর্বাচীনের মাথায় ঢোকে না। তবে দোকানের তেলচিটে চেহারার পরিবর্তন হয়ে যেত সেদিন। ঝকঝকে দোকানে সব  মালপত্তর সাজানো-গোছানো। যে কালো খেজুরপাতার ছেঁড়া চাটাইয়ের উপর কালচে হয়ে যাওয়া টাকার বাক্স নিয়ে শম্ভু মুদি চোখে চশমা এঁটে সম্বৎসর দোকানদারি করতেন, সেগুলো উধাও হয়ে যেত। বদলে খাটের উপর একটা ফুলছাপ চাদর বিছানো থাকতো, আর ক্যাশবাক্সটাও ঘসেমেজে ঝকঝকে করা হতো। ভিতরে-বাইরে একশে পাওয়ারের বিজলিবাতি জ্বলতো। ক্যাশবাক্সের সামনে শম্ভু মুদি চশমা চোখে বসে থাকতেন, সামনে লাল কাপড়ে বাঁধানো সরু লম্বা খাতা। অর্বাচীন সটান দোকানে ঢুকতেই শম্ভু মুদি একগাল হেসে বলতেন, এয়েচ? বসো।
অর্বাচীন পকেট থেকে একটা পাঁচটাকার নোট বের করে মুদির হাতে দিয়ে বলতো, মা পাঠিয়েছে।
খেরোখাতা খুলে শম্ভু মুদি একটা সাদাপাতার উপরে অর্বাচীনের বাবার নাম লিখে, নীচে লিখতেন, জমা ৫টাঃ। তারপর অর্বাচীনকে বলতেন, বসো।
দোকানের বাইরে বেঞ্চের উপর বসতো সে। দোকানের এক কর্মচারী (সেও সেদিন নতুন শার্ট আর ইজের পরতো)একটা কাগজের ছোটোথালায় জিলাপি আর বোঁদে দিত। দুইভাই সে-সব গলায় ঠেসে দেওয়ার পরেই হাতে আসতো একগ্লাস শরবৎ। দ্রুত খাওয়া শেষ করে পাছায় হাত মুছে বলতো, আসি কাকু।
শম্ভু মুদি বলতেন, দাঁড়াও।
তারপর হাতে দিতেন একটা মিষ্টির বাক্স। বলতেন, মাকে দিও।
বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে সেই বাক্স তুলে দিতেই মা খুলে দেখতো, একটা সন্দেশ আর দুটো জিলিপি। মায়ের চোখ তখন চকচক করতো।
সেই বয়স পেরিয়ে অর্বাচীন বড়ো হতে-হতে বড়ো হতে-হতে  দেখতে লাগলে হালখাতাও ক্রমশ বদলে যাচ্ছে। বদলাতে-বদলাতে এখন পয়লা বোশেখের গন্ধমাখা হালখাতা ম্লানমুখে বসে থাকে। পয়লা বোশেখ এলে অর্বাচীনের কেমন মনখারাপ হয়ে যায়। সে বেসুরো কণ্ঠে গান ধরে, "ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী, একা একা করি খেলা—"।
(চলবে)

Comments