শর্মিষ্ঠা মিত্র পালচৌধুরী

যে-বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি আজ অনেক বছর, একদিন সেখানে ফিরে দক্ষিণের বারান্দায় আবিষ্কার করলাম—জামাকাপড় মেলার তারে এক বাবুই পাখি পরম মমতায় তার ছোট্ট বাসা বানিয়েছে। কয়েকদিন অপেক্ষা করার পরও যখন তার পরিবারকে দেখতে পেলাম না, তখন মনে হলো, সেও আমার মতো কোনো প্রয়োজনে তার বাড়ি ছেড়ে উড়ে গেছে! বারান্দায় ধুলোর লুটোপুটি আর প্রতিটা জানলার খোপে পায়রাদের জমাটি সংসার! আগন্তুক দেখে ওরা প্রথমে একটু অস্বস্তিতে পড়েছিল। বসন্তের শেষে বাড়ির পিছনে সুপারি গাছগুলো সুপারিতে ভরে উঠেছে। আমগাছ কচি-কচি চিকন পাতা নিয়ে দখিনা হাওয়ায় মাথা নাড়াচ্ছে। বাড়ির সামনে বাদাম গাছে ব্রোঞ্জ আর জলপাই রঙের কাঠঠোকরা পরিবার নতুন বাসা বানিয়েছে। চৌখুপিতে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে জীবনের ট্রাজিক নভলেটের পাতা ওল্টাতে থাকি। স্মৃতিপথের আনাচে-কানাচে জলফড়িংয়ের ডানায় আঁকা রামধনুর প্রতিচ্ছবি! জীবনের প্রশ্নের না-পাওয়া উত্তরগুলো নক্ষত্রখচিত রাতের আকাশে আঁকে জিজ্ঞাসাচিহ্ন। সীমন্তিনীর সিঁদুরের রেখা অনেকদিন আগেই ধুয়ে গেছে বৃষ্টির জলে! অব্যক্ত নারীহৃদয়ের যন্ত্রণাকে বুকে নিয়ে না-ঘুমানোর প্রহর ক'জনই-বা বুঝতে পারে? মুখোশটা যেখানে বড়ো করে দেখা হয়, সেখানে শিরা-উপশিরায় বয়ে যাওয়া অভিমানের ফল্গুধারা অধরাই থেকে যায়। জ্যোৎস্নার গুঁড়োগুঁড়ো আলো মেখে ছুটে চলে সচল সভ্যতা। রাস্তায় লেগে থাকে রক্ত আর ঘাম। একগলা গ্লানি নিয়ে মিশে যাই জনস্রোতে। ছেঁড়া ডায়েরির পাতাগুলো জুড়তে থাকি অসীম শূন্যতায়। টুকরো-টুকরো হওয়া কত স্মৃতির জিগ-স-পাজল; একদিন যারা আলো হয়ে ফুটেছিল, স্ফুলিঙ্গ হয়ে জ্বলেছিল...কিন্তু সময়ের আবর্তে আজ তারা মৃত প্রজাপতি! অভিমানের মেঘ থেকে ঝরে পড়া বিরহের বৃষ্টি গড়িয়ে যায় পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। চিরপাইনের সবুজ অরণ্যে মেঘ-কুয়াশার জমাটি বুননে শুধুই স্তব্ধতা!

Comments