পিলে চমকানো হাসির দাপটে আমার নিদ্রা টুকরো-টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়লো গোটা কামরায়। চোখ মেলে দেখি, আমার ঠিক পাশের যাত্রী মোবাইলে চোখ রেখে মন খুলে হাসছেন। রিলস দেখছেন ভদ্রলোক। বলার কিছুই নেই। বিরক্ত হই মনে-মনে। ভাবি, এখানেও রিলের হাত থেকে মুক্তি নেই! ভাবনাটা যেন আমার মনের ভিতর থেকে উপড়ে নিয়ে আমাকেই শোনালেন আমার সামনের সিটে বসা ভদ্রলোক। "এই ঘাতক হাসির হাত থেকে নিস্তার নেই মশাই। ঘরে-বাইরে কোথাও বসবার উপায় নেই! সব জায়গাতেই রিল চলছে সব সময়। অশান্তি, অশান্তি। তুমুল অশান্তি।"
কিছুটা অবাক হয়েই তাকাই ভদ্রলোকের দিকে।
মুচকি হেসে আমায় বললেন, " নমস্কার, আমি বাসুদেব মিত্র। ভাবছেন আপনার মনের কথা আমি জানলাম কী করে? মশাই যন্ত্রণা একইরকম হয়, দেখবার তফাৎ শুধু।"
জানালার ধারে বসবার জায়গা পেয়েছি। সারাদিন বৈশাখের চড়া রোদ মাথায় নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে আজ। ভীষণ ক্লান্ত। বিকেলের দিকে দু-চারপশলা বৃষ্টি কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছে, এই যা। নয়তো এই গরমে...
ট্রেন হাওড়া ছেড়ে লিলুয়া পৌঁছানোর আগেই আমার চোখের পাতা মুদে এসেছে। দুশ্চিন্তা মানুষকে শ্রান্ত করে তোলে। ইদানিং উৎকণ্ঠার দাপটে কুঁকড়ে রয়েছি আমি। জানালা দিয়ে শীতল বাতাস এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আমার, কারও স্নেহের পরশ বুঝি। ভালো লাগছে বেশ। মাথাটা এলিয়ে দিয়েছি পিছনের দিকে। পরিস্থিতি তেমন অনুকূল হলে ঘন্টা দেড়েক দুইচোখের পাতা এক করতে পারি। তার উপায় নেই, আমি নিশ্চিত। কারণ রিলস এবং হাসি। বাড়ি, বাজার, দোকান, ট্রেন, বাস, পার্ক এমনকি পাবলিক টয়লেট যেখানেই যাই একটা উৎকট যান্ত্রিক হাসি ভেসে আসে, কানের পর্দা ফুঁড়ে মস্তিষ্কে নিদারুণ অশান্তি সৃষ্টি করে।
"এ যে কী যন্ত্রণা, কাউকে বোঝাতে পারবেন না মশাই। থাকতে-থাকতেই এই হাসি আপনাকে চমকে দেবে।" সারা কামরায় ঘুরতে থাকে ভদ্রলোকের সন্ধানী দৃষ্টি।
"দেখুন সবাই ব্যস্ত। নজর মোবাইলের স্ক্রিনে আর মুখে হাসি। নিজেকে আনন্দস্রোতে ভাসিয়ে দেবার প্রচেষ্টা, বুঝলেন। আসলে সকলেই রোগগ্রস্ত। সেটা কাউকে বোঝাতে পারবেন না আপনি। বললেই হাজার কথা শুনিয়ে দেবে। অপেক্ষা করুন। ব্যান্ডেল পার হতে দিন, হকাররা নেমে গেলেই কম্পার্টমেন্টটাকে মনে হবে পাগলা গারদ।" থামলেন ভদ্রলোক।
"কোথায় নামবেন?"
"আমাকে বলছেন?" নিশ্চিত হতে জিজ্ঞাসা করি।
"আর কাকে বলবো! আপনি আর আমি ছাড়া কামরার সবাই ব্যস্ত।"
"মেমারি।" অতিসংক্ষেপে উত্তর দিই। ইদানিং পরিচিত-অপরিচিত কারোর সঙ্গেই বেশি কথা বলতে ভালো লাগে না। আসলে মনে শান্তি না-থাকলে যা হয়। দেখতে-দেখতে বয়স উনষাট বছর পার হয়ে গেল। কয়েকমাস পরেই স্কুলের ছোটো-ছোটো ছেলেমেয়েরা অনুষ্ঠান করে বিদায় সংবর্ধনা দেবে। এই বয়সে একটু শান্তিতে বাঁচবো, কে না-চায়! সেটা তো এমন কিছু বেশি চাওয়া নয়। বিধি বাম! সে উপায় নেই। অন্তত আমার সংসারে নেই। বাড়িতে আমরা পাঁচটা মানুষ। দুটি ঘর। একটা উঠান। আর দুটি দ্বীপ, হ্যাঁ দুটি দ্বীপ। এই আমার সংসার।
"হুম। আমিও নামবো মেমারি।" নিজের গন্তব্যের কথা শুনিয়ে দিলেন ভদ্রলোক। ভিতরে-ভিতরে বিরক্ত হই আমি। মনের ভাব লুকিয়ে রেখে কৃত্রিম সৌজন্য দেখাই। বলি, "ও আচ্ছা, ভালোই তো!"
"বিরক্ত হলেন মনে হচ্ছে?" মুখের হাসি ধরে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন ভদ্রলোক।
"না-না! দু-চার কথায় সময় কাটানো যাবে।" বলি আমি।
"দেখুন মশাই, আপনি যে ভীষণ বিরক্ত হয়েছেন..." ভদ্রলোকের মুখের কথা শেষ হয় না। আমার পাশের যাত্রী আবার হা-হা করে বিকট জোরে হেসে উঠলেন, অনেকটা যাত্রাপালার খলচরিত্রের মতো। আমি আবারও চমকে উঠি।
"ঘাবড়ানোর কিছু নেই মশাই। রিল-দর্শন। রিলস বোঝেন তো?"
"রিলস!"
দুটো ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল আমার। যাক, বাসুদেববাবুকে অত বলবার প্রয়োজন নেই।
বলি, "হ্যাঁ। কয়দিন আগেই শুনেছি শব্দটা, তবে বুঝি অনেকটা।"
"বেশ মজা করে উত্তর দিলেন তো!" বললেন বাসুদেববাবু।
"মজাই বটে!" ভাবি আমি।
সেদিন টিফিনবেলায় স্কুলে বসেছিলাম। আত্মমগ্ন। আর কয়মাস পরেই শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসর নেবো। খবরটা স্কুলের সকলেই জানে। মাঝেমধ্যেই সেটা নিয়ে ছেলেমেয়েরা নানা কথা বলে আমাকে। দেখতে-দেখতে বত্রিশটা বছর পার হতে চলল এই স্কুলে। পুরোনো দিনগুলি স্মৃতিতে আসে, উদাস হয়ে উঠি। হাজার ছবি ভিড় করে মনে। সেদিনও তেমনি পুরোনো কথা ভাবছিলাম। এমন সময় ক্লাস থ্রি-র ছোট্ট মেয়ে, শামিমা এসে মিষ্টিগলায় বলে, "ও স্যার, আপনার ছুটির দিন আমি রিলস বানাবো; বাবা বলেছে মোবাইল আনবে ওই দিন।"
তন্ময়তা ভেঙে যায়। জিজ্ঞাসা করি, "কী বানাবি?"
"রিলস-রিলস!"
শব্দটা শুনে বুকটা ভারী হয়ে ওঠে আমার। চুপ থাকি। অন্য কথা মনে আসে; আমার সংসারের কথা। শামিমা ভাবে, আমি বুঝি ওর কথার অর্থ বুঝিনি। কিছুটা বিরক্ত হয়েই বলে, "ধ্যাত, রিলস বোঝে না! আচ্ছা যেদিন বানাবো সেইদিন..." কথা শেষ না-করে দৌড়ে পালালো বন্ধুদের ভিড়ে। বোধহয় রিলস বিষয়ে আমার অজ্ঞতার কথা ওর বন্ধুদের বলতে।
'রিল' শব্দটা কয়দিন আগেই শুনেছিলাম আমার ছোট্ট নাতনির মুখে। কয়দিন আগে সন্ধেবেলায় বসে ছিলাম দুয়ারে। পাশের ঘরে ছেলে আর বৌমা। রান্নাঘরে ব্যস্ত আমার স্ত্রী। হঠাৎ করে আমার নাতনি আমাকে বলে, "দাদু আমার জন্মদিনে রিলস বানাবে তুমি? মা বলছিল বানাবে। সবাইকে দেখাবে কত বড়ো অনুষ্ঠান হবে। সবুজ আংকেলের ছেলের জন্মদিন হয়েছিল, ফেসবুকে আমরা ওদের রিলস দেখেছি। বাপরে, তুমি বিশ্বাস করবে না কত!" নাতনির কথাগুলো কানে এলেও অর্থ বুঝিনি। ততক্ষণে পাশের ঘর থেকে বৌমা এসে মেয়েটাকে টেনে নিয়ে চলে গেল। "সবসময় পাকা-পাকা কথা!"
"তুমিই তো বললে সেই দিন..." ভীতগলায় বলে আমার নাতনি। তারপর...
বাচ্চা কাঁদলে কষ্ট পাই। মেয়েটাকে আনতে যাই ওর মায়ের কাছ থেকে। রান্নাঘর থেকে আমার স্ত্রী চিৎকার করে নিষেধ করে আমাকে। "ওদের সমস্যা ওদেরকেই বুঝে নিতে দাও।"
"ওদের সমস্যা মানে? একবাড়িতে...।"
"আমি যা শুনেছি তোমাকে বললাম।" বলে আমার স্ত্রী।
এরপর আমার ঠিক কী করা উচিত বুঝিনি। দাঁড়িয়েছিলাম খানিকক্ষণ অবুঝের মতন। তবে সংসারে একটা দড়ি-টানাটানি চলছে টের পেয়েছিলাম। এমন কতই হয়; তাই ভাবিনি বেশি সেই নিয়ে, পরিবারের অভিভাবক আমি। তবে বাচ্চা মেয়েটার মুখে 'রিল' শব্দটা শুনে সেটির অর্থ জানতে আগ্রহী হয়েছিলাম। রাতের বেলায় স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম "রিলস কী? কোনো খেলনা নাকি, জানো তুমি?"
"সে কি আর আমি বুঝি? তবে তোমার নাতনির জন্মদিন পালন করতে হবে ধুমধাম করে। তোমার বৌমা আর ছেলের তেমন ইচ্ছে। ওদের কোন বন্ধু কলকাতায় থাকে। তাদের ছেলের জন্মদিনের অনুষ্ঠান করেছে দেখবার মতো করে। মোবাইলে সেইসব ছবি দেখে সেদিন তোমার বৌমা বলছিল সামনের মাসে নাতনির..."
কী সর্বনাশ! একবছর হয়নি মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। এখনও সেই ধাক্কা সামলে উঠতে পারিনি আমি। এর মধ্যে আবার লোন করে ছেলের বাইক কিনতে হয়েছে, নয়তো চলছিল না আর ওর চাকরিজীবন। আর এইবার...
"ব্রজেনবাবুর নাতনির জন্মদিনের দিনেই তোমার বৌমা আর ছেলে..." বলে আমার স্ত্রী।
পাড়ার ব্রজেনবাবু কয়দিন আগে এলাকা জানিয়ে নাতনির জন্মদিন পালন করেছেন। আমি আমন্ত্রিত ছিলাম, অনুষ্ঠানের আড়ম্বর নিজের চোখে দেখেছি। ব্রজেনবাবু ব্যবসায়ী মানুষ, কোটিপতি। তার সাজে। আমি সামান্য প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক। সাধ থাকলেও সাধ্য নেই। তবে নাতনির জন্মদিন বিষয়টা মনে আঁচড় কেটেছিল। হাজার হোক নাতনি তো, নিজের রক্ত। পরদিন সকালে স্কুল যাবার আগে ওকে বলি, "এই বছর তোমার জন্মদিনে একটা দারুন জামা কিনে দেবো।"
আমার কথা শুনে বেশ অবাক হয়ে ওঠে আমার নাতনি। বলে, "জামা! মা যে বলেছে কেক কাটা হবে, প্যান্ডেল হবে, আলো দিয়ে বাড়িটা সাজানো হবে, লোকজন আসবে, আমাকে সাজাবে। বড়ো করে বার্থ ডে সেলিব্রেশন হবে, রিলস বানিয়ে পোস্ট করবে ফেসবুকে, সব্বাই দেখবে আমাকে"।
দুইহাত দুইপাশে ছড়ানো। আর উজ্জ্বল হাসি মুখে নিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার নাতনি। ওর মুখের কথার চিত্ররূপ ফুটে উঠেছে আমার কল্পনায়। আমি চুপ করে যাই কিছুক্ষণের জন্য। এমন পরিস্থিতি কীভাবে সামলাবো ভাবছি। রণপায়ে দৌড়ে আসে আমার বৌমা, নাতনির গালে থাপ্পড় কষিয়ে বলে "খালি ওইসব কথা!"
রান্নাঘর থেকে আমার স্ত্রী বলে, "বাচ্চা মেয়ে, ওর কি আর সেই বোধ আছে? বাপ-মায়ের কাছে যা শুনছে, তাই বলছে। এখন শাসন করলে কী হবে বৌমা?"
বৌমার মনের তুষের আগুনে বাতাস লাগলো। "পাড়াঘরে থাকতে গেলে একটু সামাজিক হতেই হয় মা। সবার জন্মদিনে পার্টি হয়। মেয়েটা দেখছে। বুঝতে শিখছে, জন্মদিন পালন করতে হয়। এইতো ব্রজেনকাকুর নাতনির..."
"সবার জন্মদিন পালন হয়, ও দেখলো কেমন করে?" আমার স্ত্রীর প্রশ্ন।
"সে যেভাবেই দেখুক না কেন, আপনারা সেই মান্ধাতার যুগে পড়ে আছেন!" বৌমা বলে।
আমার স্ত্রীই-বা চুপ থাকবে কেন! সংসারে সবাই যদি সময়ে থামতে জানতো, আমাদের আক্ষেপ করে বনবাসের কথা ভাবতে হতো না।
"রাতদিন কে কেমন সেজেছে, কে কী খাচ্ছে, কার বাড়িটা কেমন সেজে উঠলো, কারা বেড়াতে যাচ্ছে—এই দেখতেই তো তোমরা ব্যস্ত বৌমা। রাতদিন মোবাইলে ওইসব চলছে। মেয়েটাও দেখছে তোমাদের সঙ্গে। সবকথাই আমার কানে আসে। মানুষের চাহিদা পাল্লা দিয়ে বাড়ে বৌমা; চাওয়ার কি শেষ আছে? কুঁজোও চায় চিৎ হয়ে শুতে। রাতদিন হা-হা আর হি-হি। তোমরা সব নেশায় পড়েছো।"
এইবার উঠানে নেমে এসেছে আমার বৌমা। ধারালো দৃষ্টি রান্নাচালার দিকে। গলার স্বর তীক্ষ্ম। একটা যুতসই জবাব না-দিলে সম্মান থাকে না, ভাবটা এমন। স্পষ্ট করে কেটে-কেটে বলে, " অবসরে রিলস সবাই দেখে। ফেসবুকের আনন্দ সবাই নেয়। চেনা-পরিচিত মহলের সবাই কেমন রয়েছে..."
"সেটাই তো হয়েছে সর্বনাশ, অকাজের মাথা। রাতদিন মেয়েকে বাইকে বসিয়ে ছবি, ফুলগাছের পাশে ..." বলে আমার স্ত্রী।
এইবার আসরে নামে আমার ছেলে। সে দিন বাড়িতেই ছিল। বেসরকারি ব্যাঙ্কে সামান্য বেতনের চাকরি করে। ওই অ্যাকাউন্ট ওপেন করানো, ক্রেডিট কার্ড গছানো এইসব আর কী। ছেলে ঘরের বাইরে এসে তার মাকে বলে, "এটা ম্যাটার অফ প্রেস্টিজ, মা। বন্ধুবান্ধবরা ডাকলে যাই, খেয়ে আসি। তারাও তো চায় আমার বাড়িতে হইহুল্লোড় আনন্দ-অনুষ্ঠান হোক। এর সঙ্গে মোবাইলের কী সম্পর্ক! আর ..."
এরপর বাড়িতে থাকবার সাহস ছিল না আমার। স্কুলে চলে গেছি। তবে বাকি কথা না-শুনলেও আন্দাজ করতে পারি কি ঘটেছিল। সংসার তো, কথা-ছোঁড়াছুঁড়ি একই গতেই চলে। সারাদিন বুকটা ভারী হয়ে ছিল আমার। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে সুজিতের সঙ্গে দেখা হয় রাস্তায়। সুজিত আমার ছেলেবেলার বন্ধু। আমার মুখের শুকনো হাসি দেখে বুঝেছে, কিছু একটা ঘটেছে। দিলুর চায়ের দোকানে বসে সবটা শুনলো। আমি নিচুগলায় সুজিতকে জিজ্ঞাসা করি, "রিলস কি সুজিত?"
ওর মোবাইল চালু করে আমাকে অনেক কিছু দেখালো। ফেসবুক, ইউটিউব, রিলস, লাইক, কমেন্টস, শেয়ার, সাবস্ক্রাইব সব অল্পস্বল্প বুঝলাম। অনেক কথা বললো সুজিত, আমার মন শান্ত করার জন্য। সন্ধেবেলায় বাড়ি ফিরে বুঝলাম পরিবেশ অন্যরকম, আকাশ ঘন কালো মেঘে ছেয়ে আছে। বিপর্যয় শুধু সময়ের অপেক্ষা। এইভাবে কয়দিন কাটে, কথা নেই কারও মুখে। গোটা বাড়িটা যেন অলক্ষ্যে থাকা কারো ইশারায় চলছে।
★★★★
আজ সকাল থেকে বাড়িতে ছিলাম না। নিজের সার্ভিস লাইফের ফাইল জমা করতে কলকাতার অফিসে এসেছিলাম, পেনশনের কাজ। জীবনের শেষ কয়টি দিনের ভরসা। তবে সারাদিন মন পড়ে ছিল বাড়িতে, সংসার ভাঙার ভয় মনের মধ্য ঘুরপাক খেয়েছে অনবরত।
"কী ভাবছেন?"
বাসুদেববাবুর প্রশ্নে চটকা ভাঙে আমার। বলি, "রিলস।" আমার কথা শুনে হাসছেন ভদ্রলোক।
"কী বলেছিলাম? হকাররা সব নেমে গেলেই ..."
কখন ব্যান্ডেল পিছনে ফেলে এসেছি, খেয়াল করিনি। ট্রেনে কোনো হকার নেই। প্রায় সকল যাত্রী মোবাইলে ডুব দিয়েছে। লাইন আর রেলের চাকার সংঘাতের তীব্র শব্দ ছাপিয়ে রিলপ্রেমীদের হাস্যরোল কাঁপিয়ে তোলে কামরার বাতাস। সত্যি যেন চলন্ত পাগলা গারদ।
"আমি আজকাল অনেক কিছু খেয়াল করি, জানেন। মানুষ কেমন বদলে যাচ্ছে। বেশিরভাগের কোনো গঠনমূলক ভাবনা নেই মশাই! ভাবনার মৃত্যু হয়েছে। সস্তা বিনোদনে ভেসে যাচ্ছে মানুষ, ভাসিয়েও দিচ্ছে অপরকে।"
কথাটা মিথ্যে নয়। আমার চারপাশের পৃথিবীটার কথা আমিও ভাবি। বিশেষত আমার স্কুল আমার সংসার।
"ব্যাধি-ব্যাধি! এ এক মারাত্মক মারক রোগ। সবাই সব জানে। এক্কেবারে অন্তঃসারশূন্য।" মুখের হাসি উধাও হয়েছে বাসুদেববাবুর। কপালের শিরাগুলি ফুলে উঠেছে। সিরিয়াস কিছু বলতে চান আমাকে। "আসলে কী জানেন, একটা ঘটনাকে সবার সঙ্গে শেয়ার করে বোঝানোর চেষ্টা— দ্যাখো আমিও অনেকের চেয়ে অনেক বেশি সুখে আছি। পার্থিব সুখে আমি সম্পৃক্ত, আমার অপ্রাপ্তি বলে কিছু নেই এই জীবনে। সোজা কথায় আমি কারও চেয়ে কম নই। আমাদের মনের এ এক ভয়াবহ উদ্বেগজনক অবস্থা জানেন! ইংরেজিতে একে বলে 'ফিয়ার অফ মিসিং আউট', সংক্ষেপে ফোমো। নেটে দেখতে পারেন।" চুপ করেছেন ভদ্রলোক। বাইরের দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবছেন। কামরার মধ্যে হা-হা হি-হি চলছে ক্রমাগত। বাসুদেববাবুর কথাগুলো ভাবছি আমি। বয়স তো আমারও কম হলো না। জীবনে উপলব্ধির ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে আমারও। ফিয়ার অফ মিসিং আউট! হারিয়ে যাওয়ার ভয়। ছুঁতে না-পারার ভয়। নতুন কথা। তবু অর্থ বুঝতে অসুবিধা হয় না। আসলে আমি যা নই, আমার যা নেই, আমার যা হবে না কোনোদিন— ভাবনায় সেই কঠিন সত্যের কোনো জায়গা নেই। আমার নিজের একটা অলীক অস্তিত্ব তৈরি হয়েছে আমার মনে, দিনে-দিনে। আসল আমি চাপা পড়েছে অলীক আমি-র ছায়ায়। সেই কৃত্রিম আমিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় সবার সামনে বাঁচিয়ে রাখতে মানুষ তৎপর। তাই এত-এত সমস্যা।
"এত ভাববেন না মশাই। দিন কেটে যাবে ঠিকই। আমার সংসারের সমস্যাও আপনার সংসারের মতোই। দুঃখের কথা কী বলি, ওই লাইক শেয়ার কমেন্টস রিলস আমার বাড়িতেও চলে। বাড়ির উঠানটাও ছোটো হয়ে গেছে।"
" মানে?" জিজ্ঞাসা করি আমি।
বাসুদেববাবু হেসে বলেন, "চলুন, মেমারি এসে গেছে। আবার কোনোদিন দেখা হলে বলবো।" প্লাটফর্ম-চত্ত্বরের যাত্রীদের ভিড়ে মিলিয়ে গেলেন ভদ্রলোক।
বাড়ির পথ ধরি আমি। আমার ছোটো সংসারের ছবিটা ভেসে ওঠে মনের মধ্যে। বাসুদেব মিত্র-র কথা শুনে বুঝেছি, জীবনধারা কোনদিকে এগিয়ে চলেছে। এক নতুন সমস্যা এসেছে নতুন চেহারা নিয়ে, তাকে বরণ করতেই ব্যস্ত মানুষ।
বাড়ি পৌঁছতেই থমকে দাঁড়াই সদর দরজায়। অপ্রত্যাশিত বিস্ময়! দুলে ওঠে আমার পৃথিবীটা। বাড়ির পুরোনো উঠানটাকে দু-ভাগ করেছে একটা নতুন পাঁচিল, সকালে ছিল না। সংসারের আঙিনা ছোটো হয়ে এসেছে, সংসারটাও। আমার স্ত্রী আমার হাত ধরে কাঁদছে, নিজের হাতে গড়া সংসার তো, তাই কষ্ট পেয়েছে। আমার অনভ্যস্ত দৃষ্টি দেখতে থাকে আলোছায়া মেখে দাঁড়িয়ে থাকা পলেস্তারা না-হওয়া নতুন পাঁচিলটাকে।
"হাতে-পায়ে ধরে কত কেঁদেছি, শুনলো না ওরা কিছুতেই..." অঝোরে কেঁদে চলে আমার স্ত্রী। ওপাশ থেকে পরিচিত যাত্রিক হাসির শব্দ ভাসিয়ে নিয়ে যায় আমার স্ত্রীর কান্নার সুর আর আমার গভীর মনোবেদনা। বাসুদেব মিত্র-র কথাটা মনে পড়লো, "বাড়ির উঠানটা ছোটো হয়ে গেছে মশাই।"
বিধ্বস্ত মন নিয়ে দুয়ারে বসি। বুকটা ভারী হয়ে এসেছে। নাতনি ছেলে বৌমা সবার মুখটা ফুটে ওঠে নতুন তৈরি হওয়া পাঁচিলটার গায়ে। সংসারটা আমার শেষে ভেঙেই গেল। ভীষণ একটা ভয় জাঁকিয়ে আসে মনে। কিছুদিন পরে হয়তো দেখবো আরও একটা নতুন পাঁচিল ওই পাশের ছোটো উঠানটাকে আরও ছোট্ট করে দিয়েছে। আর আমার নাতনিটা কাঁদতে-কাঁদতে এই উঠান ওই উঠান ছুটে বেড়াচ্ছে উদ্ভ্রান্তের মতো। নিরাপত্তাহীনতার ভয়াল ছাপ ফুটে উঠেছে ওর মুখে। হতেই পারে এমনটা, অস্বাভাবিক তো নয়। ঘুণধরা মনের উপর কি ভরসা রাখা যায়! রিলস-সর্বস্ব জীবন। আসল জীবন নিয়ে ভাবার সময় কোথায়!
Comments
Post a Comment