"বুকের মধ্যে কিছু মেঘ জমা ভালো;/মাঝে মাঝে ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টি নামবে।"—সহজ অথচ গভীর এই দুটি পঙক্তি দিয়ে শুরু হয়েছে শর্মিষ্ঠা মিত্র পালচৌধুরী-র প্রথম একক কাব্যগ্রন্থ অনুভবের যাপনকথা । অথবা ধরা যাক ঠিক তার পরের কবিতা 'বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি'-র কথা, যেখানে কবি লিখছেন "আর এখানে এসো না সিদ্ধার্থ.../এখানে তুমি শুধুই পদ্মাসনে উপবিষ্ট/প্রস্তরখণ্ড;"। কবিতার বই এমন সরল অথচ অনুভবী পঙক্তি দিয়ে শুরু হলে, পাঠকের আশা জাগে অনেক। এই বইও তার ব্যতিক্রম নয় এবং এই বইয়ের প্রথম কয়েকটি কবিতা সেই আশায় ইন্ধন জোগায়। বিশেষ করে, কবি যখন প্রকৃতি-পরিবেশের ক্ষয় নিয়ে তাঁর কষ্ট লেখেন—"শাল মহুয়া পিয়ালের জঙ্গলে আজ আর্তনাদ"। অথবা 'উপলব্ধি' কবিতায় লেখেন জীবনের গভীরতম উপলব্ধি—"যোগে যা বুঝিনি, তা বুঝলাম বিয়োগে!"
কিন্তু আক্ষেপের বিষয়, পাঠকের সেই আশা খুব তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যাবে, যখন তিনি পড়বেন "হৃদয়ের ঘোর আকুলতা নয়নে ঝরে অবিরত;" বা "মেঘেরা গর্ভভার,/রাখিতে পারে না আর;/ ঝরঝর পড়ে ঝরিয়া।/ গরজি গুরু গুরু,/ ভয়ে বুক দুরুদুরু" ইত্যাদি। বাংলা কবিতার যাঁরা নিয়মিত এবং মনোযোগী পাঠক, বাংলা কবিতার বিবর্তনের ধারা যাঁদের কাছে স্পষ্ট, তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন এই ভাষা ও ভাব বাংলা কবিতা অনেক-অনেক বছর আগেই ছেড়ে এসেছে। সত্যি কথা বলতে কী, আগস্ট ২০২৪-এ প্রকাশিত একটি কবিতার বই পড়তে গিয়ে এমন কবিতাও পড়তে হবে, এটাই অবিশ্বাস্য! বিশেষত সেই কবির বইয়ে, যিনি লিখতে পারেন—"ফুল্লরার মেয়েটা হলুদ ফিতের ফুলে দুটো/বেনি বেঁধে এমু পাখির মতো দৌড়াচ্ছে.../এমু পাখির দৌড়িয়ে সুখ!" যদি ধরে নিই, ওই "বিরহী বরষা সহসা ব্যাকুল আগমনি গান শোনাতে।" অথবা "গোধূলি যখন আসিল ধরায়/চরাচর করি ব্যাপ্ত—" টাইপের পঙক্তিময় কবিতারা তাঁর কবিতা লেখার শুরুর দিনগুলোর, যে-স্তর তিনি পেরিয়ে এসেছেন অনেক আগেই; তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায়। প্রশ্নটা এই যে, কবি নিজের প্রথম বই করতে গিয়ে কবিতা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হলেন না কেন? নিজের সৃষ্টির প্রতি মমত্ব থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু একটি কবিতার বই যেহেতু একজন কবির প্রতিনিধিত্ব করবে বর্তমান থেকে ভবিষ্যতেও, তাই বইয়ের কবিতা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে একটু নির্মম হতে পারলে অনুভবের যাপনকথা আক্ষরিক অর্থেই একটি স্মার্ট বই হতে পারতো। মুশকিল হচ্ছে, এই বইয়ে ওইরকম অসতর্কভাবে অন্তর্ভুক্ত কবিতার সংখ্যা অনেক; যা সামগ্রিক মানের দিক থেকে বইটির বিপক্ষেই কাজ করেছে।
নির্মাণের দিক থেকে অবশ্য অনুভবের যাপনকথা বেশ স্মার্ট। বইটির মুদ্রণ ও বাঁধাই সুন্দর। কাগজের মান ভালো। ঋতুপর্ণা খাটুয়া-র করা প্রচ্ছদ অসাধারণ না-হলেও, আকর্ষণীয় তো বটেই। ব্যাক-কভারে কবির সচিত্র পরিচিতি লেখার কায়দাটি সুন্দর। তবে বইটির নির্মাণে একটি মাইনাস পয়েন্ট হয়ে থেকে যাবে তার বেশ কিছু ছাপার ভুল। যেমন, ব্যাক-কভারেই কবির পরিচিতিতে লেখা হয়েছে "বেশি বিদেশি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর অনেক কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প প্রকাশিত হলেও..."—এখানে প্রথম শব্দটি যে সম্ভবত 'দেশি' হওয়া উচিত, তা সচেতন পাঠক বুঝতে পারবেন। কিন্তু একটি বইয়ের মলাটেই যদি এত বড়ো ভুল থাকে, তা যে প্রকাশকের দক্ষতার বিরুদ্ধেই যায়, সেকথা কি বই টার্মিনাস-কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখবেন? একইভাবে বইয়ের ভিতরে পড়তে গিয়ে হোঁচট খেতে হয় 'ভ্রাতৃদ্বিতীয়া'-র মতো পরিচিত উৎসবকে 'ভাতৃদ্বিতীয়া' হয়ে যেতে দেখে। অথবা "ভরে যাক নোনা জলে দুনিয়া/চেষ্টায় ফেটে যাক ছাতি.../কাঠফাটা রোদে বুক ভরা পিপাসাই নিয়তি।" পড়ে পাঠক অনুমান করে নেন, এখানে দ্বিতীয় পঙক্তির 'চেষ্টায়' সম্ভবত 'তেষ্টায়' হওয়া উচিত। কিন্তু এই অনুমান করে নেওয়ার প্রয়োজনটা তো কোনো কাজের কথা হতে পারে না! লেখালেখির জগতে প্রচলিত যে-সব কথা জেনে আমরা অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চেয়েছি, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল—একটি মুদ্রণপ্রমাদ একটি কবিতাকে হত্যা পর্যন্ত করতে পারে! যেহেতু একটি কবিতায় ব্যবহৃত শব্দের সংখ্যা খুব সীমিত, তাই প্রত্যেকটি শব্দই হওয়া উচিত অনিবার্য এবং তারা যেন প্রকাশিত হয় নির্ভুল। 'শুভ মহালয়া' কবিতার শেষ পঙক্তিতে পড়লাম, "ভক্তি ভরে প্রণাম জানাই তাঁদের উদ্দেশ্যে।" এই 'উদ্দেশ্যে'-র পরিবর্তে যে 'উদ্দেশে' শব্দটি ব্যবহার করা উচিত ছিল, তা কি আমাদের মনে হবে না? আমরা জানি না, চোখের জন্য পীড়াদায়ক এইসব ভুল কবির কাছে, প্রকাশকের কাছে আদৌ গুরুত্বপূর্ণ ছিল কিনা!
তবে পাঠক হিসেবে আমরা শেষ পর্যন্ত একটি বইয়ের মধ্যে সিলভার লাইনিং-ই খুঁজতে চাই। তাই এই বই পড়তে গিয়ে মনে রাখবো 'প্রিয় বসন্ত' কবিতার "সারাবছর ধরে আমার সবুজ পাতায় যে/শহুরে কার্বন জমা হয়েছে;/দ্যাখো, আজ আমি তা অনায়াসে ফেলে দিচ্ছি।" মনে রাখবো 'আমিই সে' কবিতাটি, যেখানে কবি শর্মিষ্ঠা লিখছেন—"আমি ব্রহ্মার সরস্বতী,/বিষ্ণুর লক্ষ্মী, এবং মহেশ্বরের দুর্গা।/আমি শুধুই মাংসখণ্ড নই;/ পাঁজরের হাড়ের মধ্যে টর্পেডো ধারণ করি।/আমারই অশ্রুধারায় অলকানন্দার সৃষ্টি!/মানবতার হত্যাকারীকে নিধন করতে আমার/এতটুকু সময় লাগে না!/আমি চিত্রাঙ্গদা শুধু সুরূপ নয়;/আমার কুরূপ-কে সম্মান করতে শিখুন!/আমার লোহিত কণিকার মধ্যে আছে/ফুটন্ত ম্যাগমা!/আমার ডানার উপর যে অদৃশ্য রজ্জুর বন্ধন দিয়েছেন/তা খুলে দিন!/নয়তো/এই হত্যা বা আত্মহত্যার দায় আপনার!" এই কবিতার মধ্যে সচেতন পাঠক নিশ্চয়ই পূর্বসূরি কয়েকজন কবির বিশেষ কিছু কবিতার ছায়া খুঁজে পাবেন; তবুও এমন কবিতা মনে রাখতে ইচ্ছা করে; মনে থেকেও যায়। ঠিক যেমন, 'জাগরণ' কবিতায় "এই মেয়ে, তুই উলটো স্রোতে যাবি?/জেনে রাখিস, চাবুক কিন্তু খাবি!" অথবা "হাজার শোষণ! অত ভেবে নেই কাজ—/এই মেয়ে, তুই একলা চল তো আজ!" মনে থাকবে "আমার একটা চিলেকোঠার ঘর আছে;/যেখানে আমার আরাধ্য দেবতার অধিষ্ঠান।/দীর্ঘ, ঋজু, উজ্জ্বল চোখ, পরনে আলখাল্লা—/নতজানু হয়ে ছুঁই, আমার ধর্মগ্রন্থ 'গীতাঞ্জলি'।" উল্লেখে অথবা অনুল্লেখেও যে আজও রবীন্দ্রনাথ অনিবার্যভাবে অধিকাংশ বাঙালি কবির সৃষ্টিতে জুড়ে থাকেন, এই কবিতা তার উজ্জ্বল উদাহরণ। সবমিলিয়ে অনুভবের যাপনকথা শর্মিষ্ঠা মিত্র পালচৌধুরী-র পরবর্তী কাব্যগ্রন্থের জন্য অপেক্ষা করতে উৎসাহী করেই তোলে; শর্ত একটাই—পরের বইয়ের জন্য কবিতা বাছাইয়ের সময়ে তাঁকে একটু খুঁতখুঁতে হতে হবে।
অনুভবের যাপনকথা | শর্মিষ্ঠা মিত্র পাল চৌধুরী | বই টার্মিনাস, বারাসাত, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত | ১৭৫ টাকা
Comments
Post a Comment