জীবন যতটা না যত্নের ঠিক ততটাই যাতনার! না, এখানে আমি নামীদামি মানুষের কোনো উক্তি ব্যাখ্যা করবো না। জীবন নিয়ে শুধু আমার কিছু ভাবনা লেখার চেষ্টা করবো। জীবন অনেকটা নদীর স্রোতের মতন, যা উৎসে ফিরতে পারে না ঠিকই; তবুও বয়ে যেতে-যেতে সে বহন করে নানারঙের নুড়ি, কাঁকর, বালি, পলি—আরও কত কী! তার সঙ্গে বহন করে ভালো-মন্দ, আশা-নিরাশাময় কত অভিজ্ঞতার এক সুতীব্র সুগন্ধী অনুভূতি! জীবন যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ যেন বোধবুদ্ধির আতর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে তার নিজস্ব আঙ্গিকে। অথবা শাণিত তরবারির সেই সূঁচালো ধার, যার মধ্যে দিয়ে মাথা উঁচু করে সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়া যায়। আর এই চলার পথে অবশ্যই মাথা নত হয়ে যায় স্বাভাবিকভাবেই, পথের দু'পাশে নামহীন রঙিন ফুলেদের কাছে; ওই আলোকস্পর্শী নীলাকাশে বা গাছের পাতার সবুজ ক্লোরোফিলে, রাতে দূর-আকাশের নীরব তারাদের মিছিলে, সকালে নরম আলোর সূর্যরশ্মির কাছে—যারা প্রতিনিয়ত রসদ জোগায় জীবনে বেঁচে থাকার! আমার কাছে জীবন এরকম রূপ-রস-গন্ধভরা এক প্রবল অনুভূতিময় গল্প; যেখানে কোনো গল্পকার পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জুড়ে শব্দবিন্যাস করে গেছে, তার কলমের ছোঁয়ায় জীবন্ত এক সতেজ প্রাণের।
যদিও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জীবনের ছন্দ হয় মন্থর, ঠিকই তখন থমকে যেতে হয় হঠাৎ! তবে থেমে যাওয়া নয়, অন্য কোনো বিকল্প রাস্তা ঠিকই খুলে যায়।আসলে সব প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে অভিযোজিত হতে-হতে হয়তো মানুষ বারংবার নিজেকে মেলে দেয় আলোর উৎসারে; সেখানে আঁধারের শেষবিন্দুটা ছুঁয়ে দেখার অভিপ্রায়ের শেষে আর কিছু বাকি থাকে না আর তারপরেই হয় আলোর উত্তরণ; যা তার বেঁচে ওঠা জীবনকে নিঃসাড়ে এগিয়ে নিয়ে যায় জীবনের অমোঘ পরিণতির দিকে। কী অসম্ভব সুন্দর সেই আবছায়ার অনুভূতি! যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোনো দেবশিশু তার মায়াজড়ানো হাসিতে শান্তির দৃঢ় বাণী আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে দিয়ে জীবনকে কলুষমুক্ত করে তুলছে বারংবার। এখানেই জীবনের সার্থকতা! আনন্দ, ইচ্ছে, এক অজানা ফল্গুধারার অভিষেকে অভিসিক্ত হওয়া, পূর্ণিমার দুধেলা রাতে এক মায়বী অনুভূতি; রূপকথা নয়, বাস্তবতার চূড়ান্ত পাণ্ডুলিপি।
হয়তো-বা সময়ের পলিস্তরে জীবনের নোনাধরা নদীতে শ্যাওলার আস্তরণে গতি শ্লথ হয়ে আসে। জলের মধ্যে সাদাটে-নীলচে রঙের জলছবি ভেসে ওঠার পরিপর্বতে সবুজাভ তুলি বুলিয়ে দেয় কোনো নিরাকার বেনামি জাদুকর। জীবন তখনও গাঢ় রহস্যময় সুললিত প্রাচীন প্রবাদের মতো জেগে থাকে, জাগিয়ে রাখে, বেঁচে থাকে তার আতরগন্ধী স্পর্শটুকু নিয়ে। এরচেয়ে পরম প্রাপ্তি বোধকরি আর কিছু হয় না। তাই জীবন শিখিয়ে দেয় যে সম্মিলিত অণু-পরমাণুর অন্তর্নিহিত ছোটাছুটির মাঝে অনন্ত অবকাশে একফালি সবুজের ঘেরাটোপে আমরা বেঁচে থাকি আদি-অনন্ত কালব্যাপী সময়ের হাতে হাত ধরে। টাইম মেশিনের একটা শব্দ অনুক্ষণ ছড়িয়ে পড়ে, চারপাশে অনুরণন তোলে জীবনের সম্ভাব্য বা অসম্ভবের আয়ুরেখা জুড়ে। চলাচল শুরু হয়ে যায় এক সুগভীর বোধশক্তির!
তবুও মন ছুটে যায় জীবনের সুখ-দুঃখের জোয়ারে, প্রাণহিল্লোল তোলে কখনও, আর কখনো-বা ঈশানকোণে কালো মেঘ জমে ওঠে। সাময়িকভাবে বিস্তৃতির অতলে তলিয়ে যেতে-যেতে চোখ বুজে আসে ক্লান্তিতে আর তারপরেই হয় আলোর উৎসারে এগিয়ে যাওয়া। তাই বেঁচে থাক জীবন! আরও নিবিড় হোক তার দৃঢ় আলিঙ্গন, মজবুত হোক বেঁচে থাকার তাগিদ। আজ, কাল, আগামী সমৃদ্ধ হোক জীবনের উজ্জ্বল ছবি। মানুষ বেঁচে উঠুক জীবনের নীল অবগাহনে!
Comments
Post a Comment