মেঘ-রৌদ্রের লুকোচুরি খেলা চলছে। গ্রীষ্মের দাবদাহে মানুষ ভাজাপোড়া। অর্বাচীন ভাবে, এই মে মাস, মানে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ, বাঙালি একটু বাঙালি হয়ে ওঠার চেষ্টা করে। এটা বাংলার সংস্কৃতির মাস বলে আমবাঙালি মনে করে। যেন বাকি মাসগুলোতে বাঙালির সংস্কৃতি বলে কিছু নেই। এর কারণ কী? এই কারণটাই হল যত গোলমেলে। এই মে মাসে, মানে পঁচিশে বৈশাখ বাঙালির কবি মহাঋষি রবি ঠাকুরের জন্মদিন। যদিও মে মাস শুরু হয় ঐতিহাসিক 'মে দিবস' দিয়ে, কিন্তু কে আর তা মনে রাখে! সভ্যতার বনিয়াদ যাদের নিবিড় শ্রমে গড়ে ওঠে, সেই শ্রমিকদের লড়াই-সংগ্রাম, শোষণের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার যে-ইতিহাস, তারই পুর্নপাঠের দিন যে মে দিবস, তা কি শ্রমিকরাই মনে রেখেছে? বরং একটা সরকারি ছুটি পেয়ে মাংস-ভাত খেয়ে একটুকরো দিবানিদ্রা দিয়ে শপিং মল ঘুরে আসাটাই বাঙালির, বিশেষত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর মে দিবস যেন দু-একটা রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি, যার সঙ্গে আমজনতার ব্যবধান থেকে গেল।
তবে মে দিবস ভুলে গেলেও বাঙালি রবি ঠাকুরের জন্মদিন ভোলে না। সেদিন রবীন্দ্রচর্চার কী ধুম! অর্বাচীনের মাথাটা ঝাঁ করে গরম হয়ে গেল। নিজের মনেই বিড়বিড় করে, শা...,সংস্কৃতির কী বুঝিস রে? রবি ঠাকুরের দুটো গান আর চারটে পদ্য আওড়ালেই রবীন্দ্রচর্চা হয়ে গেল? রবীন্দ্রনাথকে না-পড়ে, না-বুঝেই? অত্ত সহজ? ধুউউউউস্।
তা অর্বাচীন যাই বলুক, বাঙালি তার কথা শুনবে কেন? মুফতে বাঙালি সংস্কৃতিচর্চার একটা দিন পেয়ে গেল, ছাড়বে কেন? খোঁপায় জুঁইফুলের মালা জড়িয়ে "এসো হে বৈশাখ এসো এসো" গাইবে। এই গান গাওয়ার জন্য সাতদিন 'প্যাকটিস' করেছে। হুঁ-হুঁ বাবা, ইয়ার্কি নাকি?বললেই হলো!
হাই বাপ! শুধু রবি ঠাকুর কেন, নজরুলও তো আছে। এই মাসেই তো তাঁর জম্মদিন। একজন মাসের প্রথমে, অন্যজন শেষের দিকে। ছোট-ছোট...নজরুলের ছবি নিয়ে আয়, পাশাপাশি পুজো হবে।
অর্বাচীন ভাবে, বাঙালির হলোটা কী! সেদিনের উৎসাহে যেন ভাঁটা পড়েছে। এই ক'বছর আগেও তো পাড়ায়-পাড়ায় মঞ্চ বেঁধে রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী পালন করা হতো। অর্বাচীন যে-মফস্বল শহরে মানুষ, হাফপ্যান্ট থেকে ফুলপ্যান্টে ওঠার বয়সে দেখেছে এপাড়া-ওপাড়ায় পঁচিশে বৈশাখ যেন উৎসব-উৎসব গন্ধ বয়ে বেড়াতো। সকাল থেকে মাইকে বাজতো "তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি"। বাড়ি-বাড়ি থেকে চৌকি, চাদর নিয়ে এসে মঞ্চ বাঁধা হতো। পাড়া থেকে একটাকা দু'টাকা তুলে মাইক ভাড়া করা হতো। সন্ধেবেলা পাড়ার ছোটোরা কবিতা বলতো, গান করতো, নাচ করতে। শহরের দু-চারজন পরিচিত শিল্পীকে আমন্ত্রণ জানানো হতো। তাঁরা গাঁটের কড়ি খরচ করে এসে গান গেয়ে, কবিতা বলে যেতেন। পেতেন শুধু একভাঁড় চা আর একটা খাস্তা বিস্কুট। তাতেই তাঁরা খুশি।
এই রবীন্দ্রজয়ন্তী নিয়ে গোলও কম হতো না। একবার পাশের পাড়ার এক কিশোর এসে বললো, আমি কবিতা বলবো। সবাই জানতো, সে বেশ বলতে পারে। ঘোষক মেয়েটি তার নাম ঘোষণা করতেই মঞ্চে উঠে "কুমোরপাড়ার গরুর গাড়ি" বলতে শুরু করলো। সেই কবিতা শেষ হতে-না-হতেই 'কেনারাম বেচারাম' নামে অন্য কবির একটি আখ্যান কবিতা বলতে আরম্ভ করলো। তাড়াতাড়ি তাকে মঞ্চ থেকে নামানো হলো। পরে জানা গিয়েছিল, কোনো এক বেয়াদপ পিছন থেকে তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল সেই কবিতা বলার।
সেদিন আর নেই। এখন তো সবই হয় শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক, নতুবা প্রাতিষ্ঠানিক। মফস্বলগুলোতেও সেই জাঁক কমে গেছে। সব কিছুর মধ্যে হয় রাজনীতি, নয় বাণিজ্যিক গন্ধ। রবীন্দ্রনাথকে ভাঙিয়ে কতজন যে করে খাচ্ছে! অর্বাচীন ভাবে, এই রবিবুড়ো যদি না-জন্মাতো, এদের যে কী হতো! একবার এক তরুণ কবি লিখেছিলেন "ভাঙিয়ে খায় রবিঠাকুর"। বেশ হইহই হয়েছিল সেই লেখা নিয়ে। তবে মজার হলো, যারা রবিঠাকুরকে ভাঙিয়ে খায়, তাদেরই দু-একজন বলেছিলেন, লেখাটা বেশ হয়েছে।
আপনমনে অর্বাচীন ভাবে, কালে-কালে হলো কী! সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। বাংলার সংস্কৃতিটাই গোলমেলে হয়ে গিয়েছে। ক্লাবগুলো এখন আর রবীন্দ্রজয়ন্তী করে না। তারা শুধু দুগ্গাপুজো আর মেলা করে। এজন্য সরকার মোটা টাকা অনুদান দেয়। সেই টাকায় ক্লাবগুলো বাড়ি বানিয়ে ভাড়া দেয়। অর্বাচীন একবার এক ক্লাবকর্তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আপনারা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেন না?
সেই ক্লাবকর্তা উত্তর দিয়েছিলেন, সংওসকিতি? ওসব রবীন্দসদনে হয়। আর টিবি-তে হয়ই। মন করলে চ্যানেল ঘোরাও আর সংওসকিতি দ্যাখো। খামাকা কেন বাওয়াল দিচ্চেন দাদা। আপনার ইচ্ছে হয়েচে সংওসকিতি করতে, করুন না, কে বাধা দিচ্চে!
অর্বাচীনের মাথার ভিতর ঝাঁ-ঝাঁ করে।বনবন করে। ভোঁ-ভোঁ করে গুবরে পোকা ঘুরে বেড়ায়। এসব কী হচ্ছে! বাঙালি ক্রমশ পাঁকে ডুবে যাচ্ছে। সব কিছুতেই অনীহা। 'ভাল্লাগে না ভাল্লাগে না' ভাব।এমন হওয়ার কারণটা কী? মগজটাকে কি কোথাও বন্ধক দিয়ে ফেলেছে? না-হলে এতটা তো অধঃপতন হওয়ার কথা নয়!
সেই ক্লাবকর্তা উত্তর দিয়েছিলেন, সংওসকিতি? ওসব রবীন্দসদনে হয়। আর টিবি-তে হয়ই। মন করলে চ্যানেল ঘোরাও আর সংওসকিতি দ্যাখো। খামাকা কেন বাওয়াল দিচ্চেন দাদা। আপনার ইচ্ছে হয়েচে সংওসকিতি করতে, করুন না, কে বাধা দিচ্চে!
অর্বাচীনের মাথার ভিতর ঝাঁ-ঝাঁ করে।বনবন করে। ভোঁ-ভোঁ করে গুবরে পোকা ঘুরে বেড়ায়। এসব কী হচ্ছে! বাঙালি ক্রমশ পাঁকে ডুবে যাচ্ছে। সব কিছুতেই অনীহা। 'ভাল্লাগে না ভাল্লাগে না' ভাব।এমন হওয়ার কারণটা কী? মগজটাকে কি কোথাও বন্ধক দিয়ে ফেলেছে? না-হলে এতটা তো অধঃপতন হওয়ার কথা নয়!
এই যে সংস্কৃতির গেল-গেল রব, সেও তো এই হালের খবর। গোটা সংস্কৃতির উঠোনটা যখন মাফিয়াদের দখলে চলে যায়, তখনই সংস্কৃতির অধঃপতন শুরু হয়। দু-দশক ধরে বাংলায় সেটাই শুরু হয়েছে। তাতে আবার তবলার বাঁয়া হয়ে গুবগুব করে তাল ঠুকলো কিছু ধান্দাবাজ বুদ্ধিজীবী। অর্বাচীন এসব ভাবতে-ভাবতেই দাঁত কিড়মিড় করলো। তার সারা শরীর জ্বালা করতে থাকে। মাথার মধ্যে গুবরে পোকা ভনভন করতে থাকে। কী করবে এখন অর্বাচীন? ভাবে। ভেবে কিনারা করতে পারে না। সব রাগটাকে হাঁচি দিয়ে উড়িয়ে দেয়। ধুউউউউস্-স্-স্। মাইকে ভেসে আসছে "আমার পরান যাহা চায়..."। কার প্রাণে কী চাইছে কে জানে! তবুও পঁচিশে বৈশাখের সকালে খোঁপায় জুঁইফুল, বেলকুঁড়ির মালা জড়িয়ে শাড়ির আঁচল ছড়িয়ে নারীদের ছোটাছুটি, পাজামা-পাঞ্জাবী অথবা ধুতি পরে বালক-যুবক-দামড়া-আধদামড়ার দলের ব্যস্ততা, ঘুমঘোরে মনোহরকে সরিয়ে ঘুম-ঘুম চোখে হাই তুলতে-তুলতে এই যে একদল মানুষের শ্রোতার আসনে বসে থাকা, এটাই বোধহয় এখনও বাংলার সংস্কৃতিটাকে বাঁচিয়ে রাখছে। এটাই স্বস্তির। এই স্বস্তিটুকু নিয়েই রবি ঠাকুর দাড়ির ফাঁকে মিচকি হেসে বলছেন, আমাকে এড়িয়ে যাবি? তোদের এত ক্ষমতা?
Comments
Post a Comment