ডানা আর আশ্চর্য নয়; তাই ঝাপটেও যে রক্তারক্তি লেখা থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক! কিছু আগে যে-স্ক্রিনে অগুনতি আলো লেখা ছিল, সেখানে বস্ত্রহীন-অন্ধকার। লাঠি, লাথি, জুতো কিংবা আরও শতসহস্রগুণ বেশি কিছু ছিল বরাতে। হয়তো এসবই মৃত্যুলেখার এক অনিবার্য আয়োজন! ওদিকে মহাজনেরা চায়ের কাপে তুফান তুলে আরও একটি উদযাপনের জন্য প্রহর গুনছে।
প্রহরে-প্রহরে এত ঠোকাঠুকি! বিশ্বাস করুন, ছিলই; আমরা দেখতে পাইনি। এবং দেখেও দেখিনি। এসব নিরাময়হীন ব্যাধি। বিরামচিহ্নর তোয়াক্কা করে না। কবিতা তাই শরীর ছেড়ে স্টেটমেন্ট হয়ে ওঠে, আর আমরা সোশ্যাল-মিডিয়ায় মুহুর্মুহু প্রোফাইল-পিকচার কালো করি। এবং স্টোরি কিংবা স্টেটাসে তিন ফর্মার উদযাপন রেখে আসি।
আমরা যাবতীয় ভয়াবহ ঘটনার অভিঘাত নিতে পারি না। এই আমরাই আবার পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে কস্টিউম-জুয়েলারি পরতে ভুলি না। অথবা কন্ট্রাস্ট এক্সপেরিমেন্ট করতেও ভুলি না। আনন্দসমাগম পেরোলে ধুপধাপ মনে পড়ে যায় দুরন্ত যন্ত্রণার অভিঘাত নিতে না-পারার আপ্তবাক্যসমূহ। সময়ের নখ বড়ো বিশ্বাসঘাতক। অথবা নখের সময়। দ্রোহকাল ভুলে আমরা মন ডোবাই প্রতিহিংসায়। সমস্যা বা সমাধান ভেবে বেছে নিই নিজের মতো করে। যা বিশ্বাস করি, তা করি না। যা করি, তা বিশ্বাস করি না। অদ্ভুত এক দ্বিচারিতা ছেয়ে গিয়েছে অস্তিত্ব জুড়ে। সাদা আর কালোর মধ্যবর্তী যে-'গ্রে জোন' বহাল তবিয়তে থাকে, এবং অবিরত জানান দেয় তার উপস্থিতি, সে-কথা আমরা শুনতেই চাই না! বরং "আপনি কিছু দেখেননি..."—এ-ই বড়ো নিরাপদ। কে আর উটকো ঝামেলায় মনমাথার বাসরে বিষ ঢালে!
ঘুম নেই। ঘুম নেই। ঘুম নেই। কিছুতেই দু'চোখ বোজে না। একজন মানুষ আসলে অনেকজন। প্রেমে, প্রত্যয়ে, দায়িত্বে, কর্তব্যে লক্ষ কুরুশকাঁটা। আমরা তামাশা দেখতে-দেখতে নিজেরাই তামাশা হয়ে উঠি। নিজেদের নিজেরাই বোঝাতে শিখিয়েছি, "বরং পরবর্তীতে আর কাকে ভাবা যেতে পারে, যাকে দিয়ে তাকে সিনারিও থেকে সরিয়ে দেওয়া যায়..."। আমরা নিজেদের নিয়ে এতটাই মশগুল, আমরা তীব্র সময়কেও সযত্নে সরিয়ে রেখে, নির্বোধের মতো মাথা থেকে পা পর্যন্ত কপি-পেস্ট করছি! হায় রে, আত্মবিশ্বাসহীনতা! নাকি আসলে, গল্পটার ভেতরের যে-উপন্যাসটা, সেটা ধরে ফেলেছেন; যে-কারণে ডিসকাশনে আত্মকথা, আত্মকথায় লৌকিক আবাহন, তৃপ্তস্মারক এবং একটি দুর্ঘটনা! হ্যাঁ, অবশ্যই দুর্ঘটনাই বটে। দূর থেকে সম্পর্ক ও অবস্থান দেখতে শিখুন। আবার চিটফান্ডের মতো গুচ্ছপদ্ম ও পীড়ন, তার মতো অনেক কাউকে শোনাতে হবে না তো? কিংবা, ওই ঘাড় মটকামটকির সুহানা কথা কর্ণকুহরে ভাসিয়ে দিতে হবে না তো? এই তো সেদিন আমাদের মতো জুনিয়রদের জন্য আসলে কী, কেন; এবং আপনারা আমাদের মতো নন কেন, সে-সবের কারণ ব্যাখ্যা করছিলেন; আপনাদেরই বলছি, মনে নেই? সব মনে আছে। আপনাদের স্মৃতিশক্তি লা-জবাব! যেমন, খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে মনে রেখেছেন কার পেটে কতটুকু বিদ্যে, শিক্ষে ইত্যাদি- প্রভৃতি, তেমনই। শুনুন, কানটা একটু এগোন না, আপনি যে কী ভয়ঙ্কর অনুকরণপ্রবণ, তা তো বুঝতে কারও বাকি নেই! বেশ উপভোগ করি এসব।
আমরা জলে নামি। ভুলও হতে পারি, জলের কাছাকাছি যাওয়ার একটা ছবি বানিয়ে নিতে পারি; কিন্তু গা ভেজাই না। এত সূক্ষ্ম পরিমাপ বোঝেন কী করে, আমি তো ভেবেই অবাক হয়ে যাই! গন্তব্য উত্তরে হলে, আমরা মানিয়ে-গুছিয়ে তাকে তীক্ষ্ণ দক্ষিণে ফেলে আসার মুদ্রিত ভার্সন রেডি করে প্লেস করে দিতে পারি। আমরা চাইলে, কে থাকবে আর কে থাকবে না, তার একটা চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করে ফেলি। কাকে রাখতে হবে, কাকে চাটতে হবে আর কাকেই-বা ছাঁটতে হবে, এ-বিষয়ে আপনাদের জুড়ি মেলা ভার! আর মসিহা সেজে লাভটাই কী, সেই তো থোড়-বড়ি-খাড়া, আর খাড়া-বড়ি-থোড়! এই মাফিয়ারাজের ভেতর স্থির দাঁড়িয়ে আছে আমাদের যাপন। সংস্কৃতি। সাহিত্য। সমাজ। সভ্যতা। সর্বত্র দালালি আর মাফিয়ায় ছেয়ে গেছে।
চূড়ান্ত এক কালবেলা! রাষ্ট্র-রাজনীতি সর্বত্র দমবন্ধ করা একটা সময়। মানুষ মানুষের মাংসের গন্ধ ফুসফুস ভরে নিচ্ছে! মুহূর্তে তছনছ করে দিচ্ছে তামাম স্বপ্ন। লাশের গন্ধ ক্রমাগত মহাশূন্যের দখল নিচ্ছে। কেউ কোত্থাও ভালো নেই! শিক্ষক থেকে জুনিয়র ডাক্তার; কেউ কোত্থাও ভালো নেই একদম! অন্যের জীবন স্ক্রল করতে-করতে সত্যিই আত্মপরিচিতিটাই ভুলে যাচ্ছি আমরা কী ভীষণ!
আর কত ঘুমহীন রাত পেরোলে জলদস্যু ভাসানের মধ্যবুক থেকে একটা বর্ণিল সূর্যপদ্ম আমাদের হাতে তুলে এনে দেবে, যেখানে ভ্যালিয়ামের গল্প থাকবে না, যেখানে শঙ্খ ঘোষ-এর গুচ্ছপঙক্তি আমাদের হাতগুলো এসে জড়িয়ে দেবে, যেখানে নিশ্চিন্তির ভাত পাতে পড়বে, শান্ত শান্তি থাকবে,একটা নিটোল ঘুমের পর যেখানে বাতাসে কুসুমমধু একটা জীবন রচনা করবে! ঘুমভাঙা দু-চোখে আমরা আলোর উড়ান দেখবো...
তিন ফর্মার জীবনে, ছ-ফর্মার শো-অফটা এবার বন্ধ হোক। বরং আসুন-না, আমরা সমবেতভাবে সহজ-জীবনের আরাধনা করি মগ্ন উপাসক হয়ে; যেখানে কখনও বলতে হবে না কাউকেই—
ঘুম নেই
ঘুম নেই
ঘুম নেই
খুব ভাল লাগল !
ReplyDeleteঅসামান্য শব্দচয়ণ। এই অস্থির সময়-সুড়ঙ্গের শেষ কোথায়?
ReplyDeleteদুরন্ত সময়ের অতি বাস্তব চিত্র। সত্যিই ঘুম নেই কারো চোখে। দুর্দান্ত লেখা। শুভেচ্ছা।
ReplyDelete