অভিষেক ঘোষ

বেচারা পাপাই! গত দুটো দিন তার কী কষ্টেই-না কেটেছে! ঘুম আসেনি একফোঁটাও। কারণটা মনে করলেই অজানা আতঙ্কে ভিতরে-ভিতরে শুকিয়ে যাচ্ছে সে। একে ব্রাহ্মণের মেয়ের অভিশাপ, তায় এক্কেবারে ইনসো-মুনিয়া!

এই বিপদের শুরুটা হয়েছিল গত সোমবারে। স্কুল খুলে যাওয়ার পর একদিন অন্তর একদিন তাকে কোচিং সেন্টারে যেতে হচ্ছে। আর সেখানেই পড়ান উমাপতিবাবু, তাদের স্কুলেরই ইতিহাসের প্যারা-টিচার। কথায়-কথায় তিনি লকডাউন প্রজন্মের গলদ খুঁজে বের করবেন। হ্যাঁ এটা ঠিকই যে, সে-সময় বটগাছতলায় বসে তারা একে অপরের থেকে অ্যাক্টিভিটি টাস্কের উত্তর টুকে জমা দিয়েছিল। তারপরও যখন যা টুকটাক পরীক্ষা হয়েছে, ব্যাপক টোকাটুকি করেছে তারা। মুশকিল হয়েছে, এখন না-দেখে, না-টুকে লিখতেই পারছে না তারা; হাতের স্পিডও কমেছে। তাছাড়া 'ব'-টা উলটে যাচ্ছে, সাল-তারিখ মনে থাকছে না, 'ই'-ঈ'য়ের তো ঠিকঠিকানা নেই। কিন্তু এতে তাদের কী দোষ? যত নষ্টের গোড়া তো কোভিড, তারা কী করবে? কিন্তু উমাপতিবাবুকে সেকথা কে বোঝাবে! এই ২০২২ সালে দাঁড়িয়েও তিনি ছাত্রদের যথেচ্ছ পেটান, কথায়-কথায় কানমলা। কিন্তু সে-সবও পাপাই সয়ে নিতে পারে। কেবল অসহ্য লাগে তার পিউ নামের মেয়েটাকে।

পিউ তাদের পাশের পাড়ার মেয়ে। পৈতেধারী ব্রাহ্মণের মেয়ে, তাই খুব তেজ। ওর কোনো দাদা বা ভাই নেই, পিউ তাই টমবয়-টাইপ। বড়োরা বলে, পিউ নাকি ছেলে হতে-হতে কোনোভাবে মেয়ে হয়ে গিয়েছে! আরও সমস্যা, ওরা দু'জনেই ক্লাস সিক্সে উঠেছে, নেহাৎ স্কুল আলাদা। অথচ সবসময় গায়ে পড়ে ওর সাথে ঝগড়া করবে, সহ্য হয় না পাপাইয়ের। তার উপরে আবার দু'জনে কোচিংয়ে একই ব্যাচে পড়ে। সেদিন তো বেশ বাড়াবাড়িই হয়ে গেল সেখানে।

পাপাই অর্ণবের পাশে বসেছিল শান্তিতে। পিউ দেরি করে এল, এসেই কোথাও কিছু নেই...অর্ণবকে বললো, "চল ওঠ!"

অর্ণব তো অবাক; বললো, "কেন ? আমি কেন উঠবো?"

"পাপাইয়ের সাথে দরকার আছে, ওঠ তুই ।"

পাপাইয়ের দিকে তখন তাকাতে পারবে না, এমন দিশেহারা অবস্থা তার। গাধা অর্ণবটাও তেমন, সেও পিউকে জায়গাটা ছেড়ে দিল! ব্যস! কথা নেই বার্তা নেই, উড়ে এসে পিউ জুড়ে বসলো পাপাইয়ের পাশে ।

"শোন না, একটা ছবি এঁকে দিবি স্কুলের প্রজেক্টের? তুই তো ভালো আঁকিস।" সরাসরি পাপাইয়ের কাঁধে কনুই রেখে প্রস্তাবটা দিল পিউ ।

পিউয়ের হাবেভাবে বন্ধুদের সামনে লজ্জায় মিইয়ে গিয়ে পাপাই বললো, "আ-আমি ঠিক পা-পারি না।"

"এঃ পারে না! এই যে সেদিন শ্যামলের খাতায় টিনটিনের কী সুন্দর কার্টুন আঁকছিলি দেখলাম! বেশ হয়েছিল আঁকাটা। আমার কিন্তু চাই-ই, সায়েন্সের প্রজেক্ট।"

"তো আমি কী করবো? তো-তোর প্রজেক্ট আ-আমি কেন আঁকতে যাবো?" দ্রুত জবাব দিতে গেলেই তোতলায় পাপাই।

"বাঃরে ! আমি না তোর প্রতিবেশী, তাছাড়া ছেলেবেলার বন্ধু।"

"মোটেই না! আমি কো-কোনোদিন ট-টমবয়দের বন্ধু হতে চাই না !" তীব্র প্রতিবাদ জানায় পাপাই, বলতে-বলতেই তার গাল লাল হয়ে যায়; কেন, সে জানে না।

কিন্তু ওই কথাতেই পিউয়ের গলার স্বর, কথা বলার ভঙ্গি আর হাবভাব বদলে যায়। সজোরে পাপাইয়ের বাঁ-হাতটা মুচড়ে ধরে সে, "তবে রে..." মুখে কেবল এটুকুই বলে সে।

"আঃ লাগছে। ছাড় বলছি, ডাইনি কোথাকার।" হাতের ব্যথায় কাতর পাপাই বলে ওঠে।

কিন্তু তাতেই আগুনে ঘি পড়ে। সোজা উঠে দাঁড়িয়ে তর্জনী তুলে পিউ তীক্ষ্ণকন্ঠে বলে ওঠে, "আমায় তুই ডাইনি বললি তো! এই তোকে অভিশাপ দিলাম, যতদিন না আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ক্ষমা চাইবি, তোর রাতে ঘুম হবে না। বামুনের মেয়ে হয়ে তোকে এই অভিশাপ দিলাম।"

ব্যস, তারপর থেকে দুটো রাত ঘুমহীন কাটছে পাপাইয়ের। এ যে কী যন্ত্রণা! রাতে ঘুম আসছে না শুনে বড়োমেসো গম্ভীরমুখে বলেছেন, "মনে হচ্ছে ইনসো-মুনিয়া! কিন্তু ছোটোদের হয় বলে তো শুনিনি!"

কিন্তু সেই কথাটা শুনেই একটা প্রবল ভয় জাঁকিয়ে বসেছে পাপাইয়ের মনে। কারণ আর কিছুই নয়, পিউয়ের ডাক নাম যে মুনিয়া! কোনো সন্দেহ নেই, ওই রোগই তার হয়েছে। কিন্তু শাপমোচনের উপায়? পুরুষমানুষ হয়ে একটা বাচ্চা মেয়ের কাছে ক্ষমা চাইবে সে! ভাবলেই তার দুইকান গরম হয়ে যাচ্ছে, বুকেতে ঢিপঢিপ ! কেন কে জানে, পিউয়ের সেই রক্তচক্ষু বারবার পাপাইয়ের চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এই কি তার জন্মাবধি চেনা পিউ? ওই চোখ, অমন চাহনি—কখনও কোথাও দেখেনি পাপাই। আর এই কথা ভাবলেই কেন কে জানে তার বুকের ঢিপঢিপ আরও বেড়ে যাচ্ছে; সেই সঙ্গে মনে হচ্ছে, সে যেন একটা হাওয়ার নদীতে বসে-বসে দুলছে। পাপাইয়ের মাথা সারাদিন শূন্য হয়ে আছে ।


প্রথম রাতটা জেগে কাটানোর সময় বেজায় কষ্ট হয়েছিল তার। মাঝরাতে বিছানা থেকে উঠে এসে ফ্রিজ থেকে টপাটপ দুটো মিষ্টি খেয়ে নিয়েছিল পাপাই। রাত জাগলেই ভাত হজম, তারপরই খিদে পায়। তারপর বেশ কিছুক্ষণ শুয়ে-শুয়ে ছটফট, শেষে ভোর চারটে নাগাদ উঠে পড়ে শীর্ষেন্দু-র পটাশগড়ের জঙ্গলে  নিয়ে সোজা ছাদে চলে যায় সে। সেখানেও কি শান্তি আছে! সাড়ে-চারটের সময় ছাদে উঠে এল ঠাকুমা। সুবালা দেবীর একহাতে ইসবগুলের ভুসি, অন্যহাতে ওষুধের প্যাকেট আর একগোছা সমান মাপে কেটে নেওয়া চৌকো কাগজ। এসব ঠাকুরদার জন্য ব্যবস্থা। কয়েকটা কাগজে কিছুটা ভুসি আর অন্যগুলোয় ওষুধ মাপমতো পুরে, কাগজ মুড়ে পাপাইয়ের কাছে চালান করলেন। লিখে দিতে হবে কোনোটায় সকাল, কোনোটায় দুপুর, কোনোটায় রাত। কেবল সকালেরটায় ভুসি থাকবে; সেটা দেখে, লিখতে হবে পাপাইকে। লেখা শেষ হলো তো ঠাকুমার কাঁপা-কাঁপা গলার প্রশ্ন, "কবে পরীক্ষা ?"

"কীসের পরীক্ষা ?" স্তম্ভিত পাপাই ।

"ওমা! তাহলে ভোরবেলায় উঠেচ কেন দাদুভাই?"

"ঘুম আসছে না...কী করবো?"

"বুড়োদের রোগে ধরেচে দেকচি!" বলে ফোকলাদাঁতে একগাল হাসে ঠাকুমা ।

এরপর ছোটোকাকা ছাদে উঠলো ব্যায়াম করতে। হুকুম হলো পাপাইকেও ভেজানো ছোলা খেয়ে ডন দিতে হবে। ক্লান্ত পাপাই নিরুপায় হয়ে গোটাদশেক ডন দিল কোনোমতে। তারপর হাই উঠতে শুরু করলো। কিন্তু স্কুলে যেতে হলো। ঘামতে-ঘামতে বিকেল সাড়ে-চারটেয় বাড়ি ফিরে বাথরুমে ঢুকেই পাপাই সঙ্গোপনে একটা কুকর্ম করে ফেলে; প্রায়ই করে থাকে গ্রীষ্মে। স্নানের জন্য তুলে রাখা ছয়ফুটিয়া চৌবাচ্চার ঠান্ডাজলে গলা অবধি ডুবে সে মিনিট দুয়েক বসে থাকে, তারপরই হাঁচতে থাকে। তারপর মাঠে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে দেখা হয় পিউয়ের সাথে। পাপাইয়ের পাড়ায় ছেলে-মেয়ে সবাই মিলেমিশে ক্রিকেট খেলে। এতে সুবিধে হলো মেয়েরা বল করলে ছেলেরা বল পিটিয়ে ভালোমতো হাতের সুখ করে নিতে পারে। কিন্তু বাচ্চুর ওভারের শেষ বলে ইচ্ছে করে হিট-উইকেট হয়ে গেল পাপাই; কারণ, পরের ওভারেই পিউ বল করতে আসবে! এতসব করেও পিউকে পুরোপুরি এড়িয়ে যেতে পারে না পাপাই। গোল ফ্রক ঘুরিয়ে, ধুলো উড়িয়ে পিউ নিজেই পাপাইয়ের পাশে এসে বসে, তখন সন্ধ্যা নামছে। পাপাইয়ের বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে ওঠে!

"এই নে ধর" বলে প্রায় ম্যাজিকের মতো হাত ঘুরিয়ে একটা পার্ক-এর প্যাকেট নিয়ে আসে পিউ। স্তম্ভিত পাপাইয়ের দিকে তাকিয়ে সাফাইও দেয় পিউ, "কাল তোকে অমন অভিশাপ দিলাম। নিশ্চই রাতে ঘুম হয়নি।" ব্যস, অমনি রাগ দেখিয়ে উঠে যায় পাপাই। খেয়াল করে না, পিউয়ের মুখ কেমন মলিন হয়ে গেল!


বড়োমামা এসেছিল সেদিন, সিনেমা দেখে খুব। রাতে পড়াশোনা সেরে, একসাথে দেখতে বসলো গডজিলা। ছবিতে ভয়াবহ সব দৃশ্য দেখে, যেটুকু-বা ঘুম আসার চান্স ছিল, তাও গেল! এবার সেই গতরাতের পুনরাবৃত্তি, মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিল বহুক্ষণ, পাঁচশো থেকে উল্টা গিনতি চলল কিছুক্ষণ, তারপর ফের শীর্ষেন্দু-র বই। বইটা শেষ করে নাজেহাল পাপাই অন্ধকারেই ছাদে চলে যায়। তখন রাত প্রায় আড়াইটা। গালে হাত দিয়ে চিলেকোঠার চৌকাঠে বসে ভাবে সে, ইনসো-মুনিয়া থেকে মুক্তির কী উপায় হতে পারে! ভাঙা একটা চাঁদ উঠেছে তখন।

তখনই চমক। দু'তলার ছাদের কোমর-সমান পাঁচিলের ওপার থেকে অস্ফুট শব্দ আসে, "হুই !"

"তুমি? এখানে কী করছো? ছাদে উঠলে কী করে?" আকাশ থেকে পড়ে পাপাই।

পাঁচিলের আড়াল টপকে তখন একটা শরীর ছাদে নেমে আসে। তপুদা, ভদ্রঘরের ছেলে, স্বভাবে চোর। চুরি করতে সে ভালোবাসে। কখনো-কখনো সে চোরাই মাল মালিকের হাতে ফিরতও দেয়; শর্ত হলো, যত্নে রাখতে হবে। এভাবেই ঝুমামাসির বিয়ের অ্যালবাম, কানাইদাদুর সেকেলে হাতঘড়ি, ফটিককাকুদের বিখ্যাত শঙ্করমাছের চাবুক তপুদা শর্তসাপেক্ষে ফিরিয়ে দিয়েছে। সে এগিয়ে এসে একটা লম্বাটে কাচের বয়াম কাঁধের ঝোলাব্যাগ থেকে তুলে দেয় পাপাইয়ের হাতে—"কুলের আচার, পরশু তুলে নিয়ে গিয়েছিলাম, একফোঁটা খেয়েছি, ভালো হয়নি রে, ফিরত দিয়ে গেলাম।"—বলে চলে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়ায় তপুদা। ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, "হ্যাঁরে, এত রাতে জেগে! ঘুম আসছে না!"

"নাঃ! আমার ইনসো-মুনিয়া হয়েছে।" শ্বাস ফেলে জানায় পাপাই ।

কিছুক্ষণ ভ্রূ-কুঞ্চিত করে ভেবে অবশেষে তপুদা একগাল হেসে বলে, "ওটা একটা ইংরেজি শব্দ, ইনসোমনিয়া। তোর হয়নি, চাপ নেই; ওসব তোর মতো পুঁচকেদের হয় না।"

"অভিশাপ পেলেও না!"

"অভিশাপ! সে আবার কে দিল!"

"পিউ!"

সেইকথা শুনেই হাসতে শুরু করলো তপুদা। পাপাই তাকে থামালো, "কী করছো! সবাই জেগে যাবে যে! তুমি না চোর!"

তপুদা এরপর হাসি থামিয়ে পুরো ঘটনাটা শুনলো পাপাইয়ের কাছে। শেষে মাথা চুলকে বললো, "স্যরি-টা বলেই দে, পাপাই। একটা স্যরি বললে তোর জাত যাবে না। শুধু একটু দেখে, সকলের সামনে না, একটু নির্জনে...বুঝলি? পাগল কোথাকার!" বলেই অন্ধকারে পাঁচিল টপকে হাওয়া। ভোর হতে তখন সামান্যই দেরি ।

8
স্যরি-টা বলেছিল বটে পাপাই, হাঁটু গেড়ে বসেই, নির্জন সন্ধ্যায়। তারপর ঘুমটাও তৃতীয়রাতে হলে ভালোই। তবে একটা স্বপ্নও দেখলো সে। দেখলো, পিউ একটা প্রজাপতি হয়ে ডানা মেলে উড়ছে আর সে বসে-বসে প্রজেক্টের খাতায় ওই প্রজাপতিটার ছবি আঁকছে।

Comments