দাগ-সম্পাদক মনোনীতা চক্রবর্তী সম্পাদিত আরেকটি পত্রিকা ছিল। শেষের ৪৮ পাতা থেকে। 'ছিল' না-বলে 'আছে' বলা-ই ভালো, কারণ মনোনীতা তো কখনও ওই পত্রিকাটির সমাপ্তি ঘোষণা করেননি! শুধু দাগ যেরকম প্রায়-নিয়মিত ব্যবধানে প্রকাশ করে চলেছেন, ওই পত্রিকাটির ক্ষেত্রে তা করেননি। দুটি সংখ্যার পরে পত্রিকাটি এখনও পর্যন্ত আর বেরোয়নি। কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনের স্বাভাবিক চরিত্র মেনে একটি ছোটো পত্রিকা যেমন হঠাৎই বন্ধ হয়ে যায়, তেমন হঠাৎই আবার পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠতেও পারে। তাই আমি মনোনীতার সম্পাদিত দ্বিতীয় পত্রিকাটিও আছে বলেই মনে করি। তার আর কোনো সংখ্যা প্রকাশিত না-হলেও সমস্যা নেই। কারণ, মনোনীতা তাঁর সম্পাদকীয়-পরিকল্পনার অনেক উৎকর্ষ তো দাগ-এর মাধ্যমে আমাদের হাতে তুলেই দিচ্ছেন।
দাগ-এর সাম্প্রতিক সংখ্যা নিয়ে লিখতে গিয়ে মনোনীতার অন্য একটি কাগজ নিয়ে এত কথা বলছি কেন, তার একটা কারণ তো নিশ্চয়ই আছে। ২০১৬ সালের কথা। শেষের ৪৮ পাতা থেকে-র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। আসামের একটি জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক সংবাদপত্রের (যারা তখন পশ্চিমবঙ্গেও তাদের প্রকাশ সবে শুরু করেছে) রবিবারের পাতার বিভাগীয় সম্পাদক আমাকে আরও কয়েকটি পত্রিকার সঙ্গে শেষের ৪৮ পাতা থেকে নিয়েও সংক্ষিপ্ত আলোচনা লিখতে বললেন। তিনি আমাদের অগ্রজ এক কবি এবং আজকের বাংলা ভাষায় আমার প্রিয় এক কবি। তাঁর এই প্রস্তাবে 'না' বলার কোনো কারণ-ই আমার ছিল না। কিন্তু শেষের ৪৮ পাতা থেকে-র প্রথম সংখ্যায় যে আমারও একটি গদ্য আছে! নিজের লেখা যেখানে আছে, সেই পত্রিকার রিভিউ করা কি ঠিক? মন থেকে সাড়া পেলাম না। ছদ্মনামে লিখতে আমি চাই না। নিজের নামে লিখলে, বড়োজোর নিজের লেখাটির উল্লেখ না-করে রিভিউটা লেখা যায়। কিন্তু নিজের লেখাটিও আলোচিত হোক, এই ইচ্ছেও তো আমার হয়! বরং কোনো আলোচক আমার লেখাটিকে নিয়ে ভালো বা মন্দ যা-হোক লিখুন; কিন্তু লিখবেন তো! অতএব অন্য কয়েকটি পত্রিকা নিয়ে লিখলেও, শেষের ৪৮ পাতা থেকে-র আলোচনা আমি লিখতে পারলাম না। ওই ঘটনার কথা এখানে বলার কারণ হলো, সেই একই অসুবিধা দাগ-এর অনেক সংখ্যা নিয়ে লিখতে চেয়েও আমার হয়েছে। বিগত চার-পাঁচবছরের মধ্যে দাগ-এর অনেকগুলো মনে রাখার মতো সংখ্যা হয়েছে; যাদের নিয়ে কোথাও লিখতে চেয়েছি; লেখা উচিত বলেই। দুটি বিপুলায়তন সংখ্যা জুড়ে উত্তরবঙ্গের কৃতী ও ব্যতিক্রমী নারীদের আত্মকথা-স্মৃতিকথা (তার একটিতে উত্তরবঙ্গের নদী এবং আদিবৃক্ষও ছিল সমান গুরুত্ব নিয়ে), সন্দীপ দত্ত স্মরণ সংখ্যা, কলকাতার আরজি কর হাসপাতালে কর্তব্যরত তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা জন-আন্দোলন নিয়ে 'আগুনের স্বরলিপি' সংখ্যা, উত্তরবঙ্গের ডাকঘর : পাহাড় থেকে সমতল সংখ্যা—কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলবো! কিন্তু, হয় সেই সংখ্যায় আমার লেখা আছে, না-হয় সেই সংখ্যার নির্মাণে আমার পরোক্ষ কোনো ভূমিকা আছে—যা সম্পাদক নিজের সম্পাদকীয় কলমেই উল্লেখ করেছেন। ফলে, সেই সংখ্যা নিয়ে লিখলে তো 'আলোচক আমি'-র নিরপেক্ষতা নিয়েই একটা সংশয় এসে যায়; এই আশঙ্কায় বিরত থেকেছি। কে না-জানে, কোনো পত্রিকা বা বইয়ের আলোচনা লিখতে গেলে নিরপেক্ষ থাকাটাই প্রাথমিক শর্ত হওয়া উচিত! যদিও আজকের পারস্পারিক পিঠ-চুলকানির এই বাংলাবাজারে তেমন নিরপেক্ষতা আশা করা অনেকটাই অবান্তর; তবু্ও শুধু আমার মতো সামান্য লেখকেরাই হয়তো আজও ওই প্রাথমিক শর্তটির প্রতি অনুগত থাকতে চায়।
যাইহোক, বহুদিন পরে দাগ-এর এমন একটি সংখ্যা হয়েছে, যেটা নিয়ে ওইরকম কোনো সমস্যা আমার নেই। শুধুই নারী-লেখকদের লেখা নিয়ে নির্মিত দাগ-এর 'সিঁদুর' সংখ্যা প্রায় বিদ্যুৎগতিতে মনোনীতা নির্মাণ করেছেন, মাত্র তিনদিনের প্রস্তুতিতে! হ্যাঁ, ঠিক-ই পড়লেন—মাত্র তিনদিনের প্রস্তুতিতে। ২২ এপ্রিল ২০২৫ আমাদের কাশ্মীরে পাকিস্তান-পোষিত জঙ্গিহানা ও পর্যটকহত্যার উত্তরে ৭ মে পাকিস্তানের মাটিতে ভারতীয় সেনার বীরত্বব্যঞ্জক জবাব 'অপারেশন সিন্দুর'; আর সেই জবাবি পদক্ষেপ-ই এই সংখ্যার প্রাণকেন্দ্র—যা প্রকাশিত হয়েছে ১২ মে বুদ্ধপূর্ণিমার পবিত্র তিথিতে। মাঝের ওই ক'টাদিন মনোনীতা এই সংখ্যার পরিকল্পনা করেছেন, ১০৮ জন নারীর কলমকে প্রাণিত করেছেন বিষয়টি নিয়ে কবিতা বা গদ্য লেখার জন্য, শিল্পী সৌরীশ মিত্র-কে দিয়ে আঁকিয়ে নিয়েছেন একটি অনবদ্য প্রচ্ছদ, নিজে লিখেছেন 'এবং প্রত্যাঘাত' শীর্ষক একটি অসামান্য সম্পাদকীয়। এছাড়া প্রুফ সংশোধন এবং পত্রিকার অঙ্গসজ্জা নিয়ে আরও যত পরিশ্রম করতে হয় একজন লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদককে, সে-সব তো ছিলই। এতকিছুর পরেও এত দ্রুত প্রায় ত্রুটিহীন একটি ১২৪ পাতার সংখ্যা প্রকাশ করা—সম্পাদক মনোনীতাকে অকুণ্ঠ অভিবাদন জানালেও কম জানানো হয়!
আমাদের দেশকে নিয়ে যে-আস্থা ও ভরসার কথা বরাবর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস ও ব্যক্ত করে এসেছি, 'এবং প্রত্যাঘাত'-এ মনোনীতা ঠিক সেই কথাটাই লিখেছেন প্রত্যয়ী উচ্চারণে—"আমার দেশ, আমাদের দেশ কখনোই পায়ে-পা লাগিয়ে আক্রমণ করতে যায় না। যায়নি। চরিত্রেই নেই। এ শুধুই আত্মরক্ষা। বলা যায়, প্রত্যুত্তর। প্রত্যাঘাতও।" এই প্রত্যুত্তরের নাম কেন 'অপারেশন সিন্দুর' হলো, তা আমরা জানি। বেছে-বেছে হত্যা করা হলো হিন্দু পুরুষ পর্যটকদের। অথচ তাঁদের স্ত্রীদের গায়ে আঁচড়টুকুও না-দিয়ে, পাকিস্তান-পোষিত সন্ত্রাসীরা যেন বোঝাতে চাইলো ওই নারীদের সিঁদুর মুছে দেওয়ার উল্লাস। এর জবাবের নাম 'অপারেশন সিন্দুর' হলে সমস্যা কোথায়! তবুও সিউডো-সেকুলারিজমের আড়াল নিয়ে এই নামটির প্রতি রঙ্গব্যঙ্গ ছুৃঁড়ে দিয়েছেন যে-সব 'অতিবোদ্ধা', তাঁদের উত্তরও দিয়েছেন তিনি—"এই অভিযানের সঙ্গে 'সিঁদুর' শব্দটি সংযুক্ত করে একদিকে যেমন কাশ্মীর-এর পহেলগাঁও-এ ঘটে যাওয়া সিঁথিপথের হাহাকারের অভিঘাতে অবর্ণনীয় শোকের শোধে নারীর মর্যাদাকে বিশ্বসভায় প্রতিষ্ঠা দান করেছে ভারত সরকার, তেমনই এই ভয়াবহ সন্ত্রাসবাদ দমনে এই 'সিঁদুর' যেন এই অভিযানের মঙ্গলময় বিজয়তিলকও!" যে-কথার অনুরণন পাই তনুশ্রী ভট্টাচার্য-এর টুকরো গদ্যেও—"ধর্ম দিয়ে মানুষকে চিহ্নিত করা সভ্য সমাজের লক্ষণ তো নয়ই, সেখানে দাঁড়িয়ে 'সিঁদুর' দেখে ধর্ম চিহ্নিত করে পুরুষটিকে হত্যা করা...তার পরিপ্রেক্ষিতে 'অপারেশন সিন্দূর'; এটি খুব প্রয়োজনীয়!" আসলে আমরা, প্রকৃত ভারতীয়রা, অন্ধকারের পূজারী পাকিস্তানি সন্ত্রাসবাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আলোর সন্ধানী হওয়ার শিক্ষা পাই বলেই পাকিস্তান-পোষিত ওই হত্যালীলা রুখতে চেয়ে একজন কাশ্মীরি মুসলমান ঘোড়াওয়ালার জীবনদানকেও মনে রাখা হয় অশ্রুসিক্ততায়। সেই সুরেই যেন সংহিতা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর 'অপারেশন সিন্দূর' শীর্ষক গদ্যে লেখা হয়—"তার ঘুমন্ত চোখের পাতায় হাত রেখেছে মা! এই ঘুম ভাঙবে না আর। অপারেশন সিঁদুর? তার আম্মি তো সিঁদুর পরে না!"
বৈবাহিক গণ্ডি আর বিশ্বাসের সীমাবদ্ধতার বাইরেও যে ভারতীয় সংস্কৃতিতে সিঁদুরের গুরুত্ব কম নয়, সেকথাও বারবার উচ্চারিত হয়েছে এই সংখ্যার বিভিন্ন লেখায়। সুতপা সাহা লিখেছেন, "নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শক্তিসাধক যে-কেউই সিঁদুর ব্যবহার করে থাকেন। সিঁদুরের লাল রং শক্তি ও ভালোবাসাকে বহন করে।" রিমি দে লিখেছেন, "সিঁদুর' শব্দটির ব্যবহার নিয়ে খিল্লি করা হচ্ছে, যেহেতু এখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে। এটি একটি গণতান্ত্রিক দেশ, হয়তো তাই আমরা মুখর।...আমি আজ ২০২৫-এ দাঁড়িয়ে একজন শিক্ষিত নারী হিসেবে বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে সিঁদুরকে দেখব। সিঁদুর শৌর্য-র প্রতীক। বীরত্বের প্রতীক।" শাঁওলি দে লিখেছেন, "যদিও 'SINDOOR'এর পুরো নাম আসলে Strategic Initiative for Neutralizing Destructive Opponents with Overwhelming Retaliation. তবু যে-যুদ্ধ শুরু হয়, সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর সামনে স্বামীকে বিনা অপরাধে হত্যা করার মাধ্যমে, তাকে 'সিঁদুর' নাম দেওয়া তো একধরনের প্রতিশোধই।...এ যেন চোখের ওপর চোখ রেখে সরাসরি বদলা নেওয়া, প্রতিপক্ষের মতো লুকিয়ে-চুরিয়ে নয়।"
সত্যিই তো তাই! মানসী কবিরাজ লিখেছেন, "স্বাধীনতার পর থেকে পড়শি-রাষ্ট্রের এই অকারণ উস্কানি, অমানবিক জঙ্গিহানা আমরা বহুবার দেখেছি, কিন্তু কেবলমাত্র পর্যটকদের উপর হামলা! সেটাও আবার তাদের ধর্মীয় পরিচয় দেখে! এই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা আমাদের আগে হয়নি। এ যেন হিটলারের ইহুদি-নিধন যজ্ঞ। কতটা বর্বরতা থাকলে, কতটা প্যাঁচ কষে এইধরনের হামলা চালানো হয়, যাতে করে আমাদের ভারতবর্ষের মতো ধর্ম নিরপেক্ষ দেশে ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টি করা যায়!" সিঁদুরকে প্রতিরোধের নাম দিয়ে তিনি লিখেছেন, "যে-সন্ত্রাস কেবলমাত্র পুরুষটির ধর্মীয় পরিচয়কে নিশানা করে নারীর গায়ে সবক শেখানোর অন্ধকার লেপে দিতে চায়, সে-সন্ত্রাস জানেই না ভারতীয় নারীর প্রকৃত পরিচয়। ওরা জানেই না যে শক্তিকে আমরা ‘দেবী’ রূপে আবাহন করি।"
সত্যিই তো, সিঁদুরকে যারা শুধু হিন্দু নারীর বৈবাহিক চিহ্ন বলে জেনেছে, তারা সিঁদুরের কতটুকই-বা জেনেছে! সেই গভীরতার সন্ধান দিতেই বোধহয় মধুপর্ণা রায় তাঁর স্বভাবজ কাব্যিক গদ্যে লিখেছেন, "বুকের ভেতর চমক দেওয়া নাম! সেই কবেকার কথা! প্রথম প্রেমের বার্তাটুকু বাতাসে। আমি দেখতাম, গাছের পাতার প্রান্তটুকু দিয়ে আমার অতি ছিপছিপে সিঁথির রাঙামাটির পথ। কেন এমন একটি মাধ্যম চাইতাম, সে-ও জানি না। কেন প্রকৃত সময় এলে আক্ষরিক তা প্রায় পরলামই না, তাও জানি না।
‘জানি না’-র অবোধ আলতোটুকু ছেড়ে দিলেও ‘সিঁদুর’ জড়িয়ে রইল সত্তায়। মনে হতে লাগল...‘যাহা কিছু সব আছে আছে আছে’।"
এতেও কি সবটুকু বুঝবেন না 'অতিবোদ্ধা'গণ? যদি না-বোঝেন, তার জন্যও শেষ কথাটি লিখেছেন তিনি—"ঝাপটে উঠল ভারতের ডানা। এই অবিস্মরণীয় দৃশ্য ফ্রেম হয়ে স্থির হয়ে রইল ইতিহাসে। ভারতের প্রত্যাঘাতের প্রতীক। ওই সিঁথি। ওই সিঁদুর। ‘অপারেশন সিঁদুর’। মুঠোভরে উড়ল আকাশে। জলে। মাটিতে।"
অনসূয়া সরকার বিশ্বাস সিঁদুরকে প্রতিবাদের নাম দিয়ে লিখেছেন—"শক, হুন, পাঠান, মোগল, ইংরেজ এসেছে, লুঠ করেছে, আহত করেছে। কিন্তু ভারত প্রতিহত করেছে, দমন করেছে, আবার যুগে-যুগে সব ধর্মের মানুষকে নিয়ে একসঙ্গে চলেছে। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যকেই সম্মান জানিয়েছে আমাদের সংবিধান। তাই ভারতমাতা একদিকে যেমন স্নেহের প্রতিমূর্তি, তেমনই সে-স্নেহছায়ায় আশ্রিত সব ধর্মের, নিরীহ মানুষের নিরাপত্তা, শান্তির জন্য প্রয়োজনে তিনি অসুরদলনী হতেও পিছপা হবেন না। প্রতীকী ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর মধ্য দিয়েই তার প্রথম পদক্ষেপ শুরু হয়ে গেছে।" ভারতকে বুঝতে গেলে, ভারত-আত্মাকে বুঝতে গেলে, এই কথাগুলো অনুধাবন করা অত্যন্ত জরুরি।
এইধরনের আরও অনেক গদ্যে এবং কবিতায় সমৃদ্ধ এই সংখ্যাটির আরও অনেক লেখাই আলাদা করে উল্লেখ করার মতো। কিন্তু আলোচনা অতিদীর্ঘ হয়ে গেলে আজকের জেট-যুগের পাঠক বিরক্ত হন। তবে একটি বিশেষ ঘটনা বা উপলক্ষ নিয়ে কোনো সংখ্যা প্রকাশিত হলে, তার অনেক লেখায় একই প্রসঙ্গের প্রায় একইরকম বহিঃপ্রকাশ ঘটে যাওয়া খুব স্বাভাবিক। এখানেও তা ঘটেছে। তবু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লেখকদের দক্ষতায় এবং অবশ্যই বিষয়গুণে পড়তে খারাপ লাগেনি। এসবের মধ্যেই কী অসামান্য একটি কবিতা 'নিজস্ব সংবাদদাতা' লিখেছেন মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনীয়া! রাজশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন একটি অসামান্য গদ্য 'মাৎস্যন্যায়'। সঙ্ঘমিত্রা রাউত, দেবপ্রিয়া সরকার, সুদীপ্তা সরকার, রুমি বাগচী, জবা শর্মা, অঞ্জনা দে ভৌমিক, তনয়া দাশগুপ্ত, ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য, শ্রেয়সী চট্টোপাধ্যায়, সম্পা পাল, মনোমিতা চক্রবর্তী-র গদ্য ফিরে পড়ার মতো। আর আছে কিছু মনে রাখার মতো কবিতা। বলা ভালো, কবিতার কিছু পঙক্তি। মধুমিতা চক্রবর্তী লিখেছেন, "ভুল পথে গেলেও তো ফিরে আসা যায়,/ তাই এসেছি,"। কল্যাণী লাহিড়ী লিখেছেন, "কাঁটাতার উঁচু হলে তুমি ফুল ছুঁড়বে/ কীভাবে! গুলির বদলে, বীর-জারা!" আমাদের মনের পর্দায় তখন যশ চোপড়া-সৃষ্ট ভারতীয় জওয়ান বীরপ্রতাপ সিং এবং তার পাকিস্তানি প্রেমিকা জারা হায়াত খান-এর বিরহবিধুর প্রেমকাহিনি একমুহূর্তের জন্য উঁকি দিয়েও বাস্তবতার কাঠিন্যে ধাক্কা খেয়ে মিলিয়ে যায়। মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস লিখেছেন, "ভালোবাসার রং কখন হয়ে যায় লাল..."। চৈতালি ধরিত্রীকন্যা লিখেছেন, "সিঁথির কপাটে দাঁড়িয়ে ছিল জঙ্গিঘাঁটি"। রত্নদীপা দে ঘোষ লিখেছেন, "প্রিয়মুখ। আর্তনাদ। গোলাপজীবন মৃত্যু-অবাক।" মোনালিসা চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, "এই শেষ সিঁদুরখেলায় নতুন সূর্যের আলো/ পড়লে আমি পুনরায় শুরু করব কপালে / চুমুতে রাঙাচিহ্ন দিতে।" কস্তুরী সেন লিখেছেন, "কবে ফুরিয়েছে দিন/ আলোকচিহ্নটুকু পাতাটির মনে লেগে আছে"। পাঞ্চালী সিনহা লিখেছেন, "সন্ত্রাসীরা বুঝতে পারেনি/ আমরাও বুঝতে পারিনি/ একফোঁটা সিঁদুর কখন, কীভাবে/ একটা গোটা দেশ হয়ে গেল!" পিয়াংকী লিখেছেন, "যুদ্ধই সেই সিঁদুর, যার দাগ অক্ষত হয় ভারতের জলে..."। দেবশ্রী দে লিখেছেন, "তোমার সীমানা-জুড়ে শত্রুদের সর্বনাশ/ ক্ষমাহীন ছন্দে লেখা আছে"। মাধবী দাস লিখেছেন, "আমাদের নয়নের জল যেন মরালের ডানা..."। দেবশ্রী রায় লিখেছেন, "যে-সিঁদুর মুছে দিয়ে ভেবেছিলে/ অন্ধকার ডেকে আনবে/ তার আড়ালে আমরা একেকটা সূর্য পুষি,"— এছাড়াও শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস, সুদেষ্ণা মৈত্র, শাশ্বতী চন্দ, কোয়েলা গঙ্গোপাধ্যায়, রম্যাণি চৌধুরী, নবনীতা সান্যাল, মাধুরী বরগাঁও, মনিমা মজুমদার, অণুশ্রী তরফদার, মৃণালিনী, মনামী সরকার, মনীষিতা নন্দী প্রমুখের কবিতা মনে রাখার মতো। নবনীতা সরকার-এর টুকরো কথা 'সিঁদুরখেলা' তো আসলে গদ্যের শরীরে একটি কবিতা-ই—"চন্দন কাঠের স্তূপের ওপর গড়িয়ে পড়েছে সিঁদুরের কৌটোখানা। তার গালে, চিবুকে, জামায় এখনও লেগে আছে সিঁদুরের দাগ। রাতের অভিসারের চিহ্ন। আজ যে-হোরিখেলা, সে-তো বলেনি আগে। রক্তহোলি! কারা যেন দিয়ে গেছে এত লাল রং। আর সঙ্গে কিছু মৃত্যু-উপহার। ওই যে আকাশে কিছু সিঁদুররঙা স্ফুলিঙ্গ দেখা যায়! সে-কি আগুন বর্ষণ করবে বলেই? মৃত্যুর রং এত লাল কেন হয়! কোথাও তো নেই কোনো মৃত সঞ্জীবনীগন্ধ! ঈশ্বর, তুমি কি প্রেম বিলানো ভুলে গেছ?"
আমাদের অগ্রজ-প্রজন্মের অগ্রণী লেখকদের অন্যতমা পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায়, ঈশিতা ভাদুড়ী থেকে পড়া শুরু করে পাঠকের চোখ যখন দাগ-এর এই সংখ্যার নবীনা অক্ষরশিল্পী সূর্যস্নাতা-র দৃপ্ত অক্ষরে লেখা "যে-সিঁদুর মুছে গিয়েছিল সেদিন,/ সেই সিঁদুরই হয়ে উঠল অস্ত্র—/ লাল। আগুন। প্রতিশোধ।"-এ পৌঁছয়; তখন মনে হয়, সম্পাদক মনোনীতা সত্যিই একটি অবিস্মরণীয় সংখ্যা আমাদের উপহার দিয়েছেন। শুধু একটি বিষয় তিনি ও তাঁর কয়েকজন লেখক যদি একটু খেয়াল রাখতেন যে, আমাদের সেনাবাহিনীর কর্নেল সোফিয়া কুরেশি ও বায়ুসেনার উইং-কমান্ডার ব্যোমিকা সিং এই 'অপারেশন সিন্দুর'-এ নিজেরা অংশ নেননি, বরং ভারতীয় সেনার মুখ হয়ে সারা পৃথিবীর সংবাদমাধ্যমের কাছে প্রেস ব্রিফিং-এর দায়িত্ব পালন করছিলেন এবং সেই অনুযায়ী ওই লেখাগুলো একটু শুধরে নিতেন, তাহলে সংখ্যাটি নিখুঁত হতো। তবে "কিছু ভুল থাক। কিছু ভুল থাকা ভালো।"—একথা তো মনোনীতা নিজেই বহুবার অন্যত্র লিখেছেন! তাছাড়া, বিষয়টা তো এমন নয় যে, আমাদের এই দুই নারী-যোদ্ধা এই অপারেশনে সরাসরি অংশ নিতে পারতেন না! তাঁরা অবশ্যই তা পারতেন, যেমন অতীতেও বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নিয়েছেন। এবারে তাঁরা নিজেদের উপর অর্পিত দায়িত্বটিই পালন করেছেন, এই যা। প্রসঙ্গত, বিষয়ের মর্যাদা রাখতে মনোনীতা এই সংখ্যাটিকে বিনিময়-মূল্যহীন রেখেছেন; যেমন তিনি আগেও রেখেছিলেন 'আগুনের স্বরলিপি' সংখ্যা প্রকাশের সময়ে। এই সংখ্যার ব্যাক-কভারের ইমপ্রিন্ট লাইনে "DAAG edited by MANANEETA CHAKRABARTY Priceless Issue" লেখাও হয়েছে। আক্ষরিক অনুবাদের ঝোঁকে আজকের যন্ত্রসভ্যতা ওই 'প্রাইসলেস' শব্দটিকে 'মূল্যহীন' বলে দেখালেও দেখাতে পারে। কিন্তু আমরা যেন মনে রাখি, মূল্যহীন বলতে আমাদের Worthless বোঝা উচিত। আর প্রাইসলেস বলতে বোঝা উচিত 'অমূল্য'। আর, দাগ-এর এই সংখ্যাটি তো সত্যিই অমূল্য।
দাগ | সম্পাদক : মনোনীতা চক্রবর্তী | চতুর্দশ বর্ষ একাদশ সংখ্যা | ইসলামপুর, উত্তর দিনাজপুর, পশ্চিমবঙ্গ
Comments
Post a Comment