মৌমিতা বসু

অতন্দ্র প্রহরীর মতো জেগে থাকে সময়! সেখানে শুকনো পাতার মর্মরধ্বনি এবং খসখসে শব্দ অমসৃণভাবে জেগে
রয়েছে রাত। দূর-আকাশের মিটমিটে আলোয় আদিম নক্ষত্রবলয়ের নীল দ্যুতির আলোর বিচ্ছুরণ কেমন মায়াবী কুহকজাল-বৃত্ত রচনা করে তার সৃষ্ট পরিমন্ডলে। ভারী অচেনা লাগে তখন। দু'চোখে ক্রমে জেগে ওঠে বিস্ময়; তখন ঘুমনেই-রাত নেমে আসে ধীরে!

মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে কারা যেন নামহীন ফুলের পরাগরেণু ছড়িয়ে দেয়, দু'চোখের পাতা মৌন সম্মতি জানায়। আহ্বান করে সমস্ত ক্লান্তি, গ্লানির এক উজ্জ্বল উদযাপনের ভঙ্গি। কালরাত্রির মতো জেগে থাকা সময়ের কী নিবিড়-গভীর উপলব্ধি! ওদিকে খিড়কিদুয়ার পুকুরপাড়ে একটা শিরশিরে বাতাস। বট-পাকুড়-অশ্বত্থ গাছেদের নেমে আসা প্রাচীন ঝুরিগুলো হাওয়ায় নোনা শ্যাওলাভেজা পুকুরপাড়ের কিনার ছুঁয়ে ফিরে আসে যে-যার জায়গায়। দূরে ফকিরসাহেবের পুরোনো পরিত্যক্ত প্রায় ভগ্ন জীর্ণ বাড়িটার সামনের আমবাগান নরম চাঁদের আলোয় ভিজে যায়। আকাশগঙ্গা থেকে নাকি রাতপরিরা নেমে ছোটাছুটি করে। এসব যেন দু-চোখে ঘুম নেই, জেগে থাকা রাত দেখতে পায়! আর পায় বলে অ্যালজোলামের কড়া ডোজ ফিকে হয়ে আসে। চোখে তখন ইনসোমনিয়াক রাত প্রবল আবেগে জড়িয়ে ধরে।

মফস্বলের এক-দুই বাড়ির বড়ো ঘড়িতে ঢংঢং করে রাত দুটো বেজে ওঠে। পথের কুকুরগুলো চিৎকারে জানান দেয় তাদের জাগরণ। তখন যেন কোনো নীরব কবি কথামালা দিয়ে সাজায় তার অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি! সেই কাব্যগুলো হয়তো তার ঘুমনেই-রাতের জীবন্ত সাক্ষী! রাত প্রায় শেষের দিকে এগিয়ে যায়। এমনি করেই যেন কত অযুত-নিযুত বছর ধরে ধূসর হলদে হয়ে যাওয়া ঘুমনেই-সময়ের হাত ধরে রাত কেটে যায়। রাতের শরীরে অসংখ্য বলিরেখার আঁচড় পড়ে তা কি সত্যি মিলিয়ে যায়? জানা নেই। ভাঙা-ভাঙা কিছু স্বপ্ন জেগে থাকে ফুটপাথে, যেমন জেগে থাকে রাত। তার অর্ধনগ্ন লাশের ওপর দিয়ে কারা যেন বুলডোজার চালিয়ে দেওয়ার জন্য উদ্যত হয়েছে, কারা যেন রক্তে রাঙা এক বীভৎস কঙ্কালসার রাত উপহার দিয়েছে নিষ্পাপ শিশুদের, আবার কোথাও হঠাৎ পাল্টে যাওয়া জীবন ফ্যালফ্যাল করে হাতে ফেস্টুন নিয়ে তাকিয়ে থাকে নতুন সকাল দেখবার জন্যে! নাঃ ঘুমহীন রাত, অদৃশ্য রাবারের মতো বড়ো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর, যার কোনো শেষ নেই।

শুধু মনে আছে, শেষরাতে আকাশে এক ক্ষয়াটে চাঁদ তার অস্তিত্বের জানান দিয়ে পুব-আকাশে পাড়ি দিয়েছিল আর তার সেই ছোট্ট শুকতারা তার ঘুমনেই-বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে রওনা হয়েছিলো অজানা পথে। রাতের সমাপ্তির সঙ্গে রাত জাগা ঘুমনেই-দু'চোখের সামনে পাতলা দুধের সরের মতন একটা ধূসর আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। আর রাতজাগা দুটি চোখ অপেক্ষায় ছিল আরও একটা বিনিদ্র রাতের!




Comments