অতন্দ্র প্রহরীর মতো জেগে আছে ধূসরতা।
ওষুধের শিরা-উপশিরা দিয়ে জালিকার ব্যূহ রচনা হয়। ডোপামিন ব্লকার ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়। বিন্দু-বিন্দু বিষ রক্তকণিকার দীর্ঘমেয়াদি শরশয্যার দিকে এগোয়—প্রখর রাসায়নিক সচেতনতা। রক্ত মানেই যেন লাল। রক্ত মানেই বুঝি লাল? রঙের প্রতারণা মেনে নেওয়ার অভ্যেস শহরে চাউর হয়েছে। অতনু জেগে আছে। দক্ষিণের জানলার পাশে বসে সে তাকিয়ে আছে গূঢ় রহস্যের দিকে। বৃষ্টির মৃদু ছাঁট—চঞ্চল আলো আর গাছের পাতার কথোপকথন। রহস্য রূপ বদলায়। সে হরিণ হয়ে ওঠে, তারপর গণ্ডার হয়ে যায়। অতনুও অপরাজিতা হয়—নরম নীল বৃতি থেকে উপচে পড়ে প্রসারিত পাখা, ডানা মেলে দেয়—নিজের লিঙ্গপ্রবণতাকে প্রশ্ন করে, কেন উদার হতে হলে তাকে অপরাজিতা হতে হয়।
দৃশ্য হলুদ হয়, ভাবনা ভুলে যাওয়া নামের মতো সে ভারী হয়ে পড়ে। অতনুর চোখে ঘুম আসে না। সে একা জেগে থাকে বিশ্ব-চরাচরে। একটি নিন্দিত অসুখের সংক্রমণের মতো আইসোলেটেড হয়ে পড়ে। মার্ক্সের ইডিওলজির মতো পুরাতন প্রগতিশীলতার ইউটোপিয়ান এক সফিস্টিকেশন হয়ে পড়ে। চাকরি-হারানো যুবকের অসহায় আন্দোলনের মতো হিন্ডোলিয়াম বাটি হয়ে পড়ে। দুরন্ত যুবকের মতো আগুনপাখির গান সে আর গাইতে পারে না। সে কাঁদতে পারে না। কারণ, কাঁদলে মেয়েলি লাগে। সে নাকে নথ এবং আঙুলে নেলপলিশ পরে না। লোকে ছক্কা বলে। অতনু ঈর্ষা করে অপরাজিতাকে। তাকে ধরিয়ে দেয় নগরপালের হাতে।
অপরাজিতা দক্ষিণের জানলা দিয়ে হারিয়ে যায় ভেপার লাইটে। বৃষ্টি ভেজার গল্প বলে। প্লেটোনিক ভালোবাসার ইশারা করে কম্বলের ভিতরে শরীর হয়। এক থেকে বহু। তাকে দেখা যায় না। তার যৌনতা সিম্বলিক। উগ্র প্রকাশ সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ মনে করে সে লুকিয়ে প্রশ্রয় দেয় সন্ত্রাসবাদ। সন্ত্রাসবাদী অপরাজিতা রক্তকরবীর আগল ভাঙে। দুর্গ ভেঙে নিয়ে আসে রাজার নাশকতা, নন্দিনীর ক্রুসিফিকেশন। সমবেত কবিতাপাঠ কোরাসে ধ্বনিত করে, "ফুল ফুটিবার দিন নয় অদ্য"।
উদ্ধত রাগী বেয়াদব বদতমিজ অপ্রাতিষ্ঠানিক বেসামাল মনোলগ হলেই আমারও অতনুকে দরকার হয়। হতভাগ্য লেখক। আমাকে ওর রক্তে ঢুকিয়ে দিতে হয় অ্যান্টি-পোয়েট্রি। প্যাট্রিয়ার্কি আমার চেতনাকে প্রলুব্ধ করে এভাবেই। আমি প্রতিবার অতনুর হাতে খুন হই। তারপর মর্গ থেকে শুরু হয় মার্গদর্শন। আমি অপরাজিতা হয়ে উঠি। অপরাজিতা বেয়াদব হতে পারে না। আমার নিতে অসুবিধা হয়। খিস্তিখেউড় করতে পারে না। জিভে আটকায়। পা ছড়িয়ে বসতে পারে না, যেমন খুশি জামাকাপড় পরতে পারে না। দৃষ্টিকটু লাগে। আমি ঘুরিয়ে ব্যাখ্যা করি। বলি, ব্যক্তিত্বে আটকায়। আমার পিছনে ওৎ পেতে বসে থাকা স্টকার খ্যাঁকখ্যাঁক করে নোংরা হাসি হাসে।
একটা ধারাবাহিক ঝিমিয়ে পড়া লিঙ্গবিভ্রান্তির ক্লান্তিকে আতসকাচে দেখবো বলেই হয়তো অতনু আর অপরাজিতার রূপান্তরের মধ্যে সময়কে আটকে রাখার এই প্রক্রিয়া চলে কোকুনের ভিতরে। একদিন বীজপত্র ফেটে সাহসী প্রজাপতি বেরিয়ে আসে। শহরের সব অতনু চিরকালের মতো অপরাজিতা হয়ে যায়।
Comments
Post a Comment