পারমিতা

নিদ্রা নাহি আঁখিপাতে...গোঁসাই
দেবীদীর্ঘ আনত দু'চোখে কী করে ঘুম আসে বলো?
সেই একজোড়া চোখ তো হারিয়ে যায় প্রতি বর্ষানির্জন কোনো রাতে। সেই নয়নযুগলে রাশিরাশি নয়নতারা অনন্ত বর্ষণ মেখে ফুটে ওঠে অবিরত। সেই আনত দৃষ্টিতে বেঁচে থাকে কোনো রাধিকার ব্রতকথা কতকাল।
সে-দৃষ্টিতে বেঁচে থাকে অজস্র শ্রাবণে ঢলে পড়া কোনো কদমের ডাল, জেগে থাকে ভেজামাঠ জুড়ে কোনো সুদূরে রাখালিয়া বাঁশি, কোনো দিঘির শ্যাওলামাখা ভাঙা তীর। যে-চোখে অবিরত জেগে থাকে কোনো নূপুরের নিক্কণ, সে-চোখে ঘুম আসা পাপ গো গোঁসাই! 

সে-চোখে স্থবির জল, বহু পুরোনো। অতীতকথা কোনো। কবেকার মৃত কোনো নক্ষত্রের শোক জেগে থাকে সে-দুই নয়নে; সে-শোকের আদি নেই, অন্ত নেই...বিরামহীন বিরহ জেগে থাকা দুই চোখ। মেঘ জমে-জমে একসময় ভেঙে পড়ে শ্রাবণের ধারা। অবিরত...সিক্ত।
মাটি ভিজে যায়, ভিজে যায় দিঘির পাড়ভাঙা শ্যাওলাতীর, সে-ধারায় ডুবে যায় অকূল দরিয়ার কোনো ভাঙা নাও। ভিজে যাওয়া আকাশের তারারা লজ্জায় মুখ লুকোয়। ভিজে যায় টিলার উপরে অন্ধকারের শরীরে দাউদাউ জ্বলতে থাকা কোনো শ্মশানের চিতাভস্ম। ভিজে যায় ঘুমন্ত ডাহুকের পাখনার নরম। 
ভিজে যায় চিবুক বেয়ে দুধসাদা স্তনের বোঁটা থেকে উদ্ভাসিত দুই করুণ পানিশঙ্খ। ভিজে যায় শরীরের গভীর মধ্যরেখায় আটকে থাকা একটা আস্ত ব্ল্যাকহোল। ভিজে যায় সেই ছায়াশরীর থেকে জন্ম নেওয়া অসংখ্য...অসংখ্য ছায়াপথ । 
কী নাম তাদের দেবে গোঁসাই?  আকাশগঙ্গা, নেবুলা না আন্দ্রমেডা? তাদের কোন ব্রহ্মাণ্ডের পাঠ পড়াবে বলো?‌ চুপ, চুপ! যে-চোখে জেগে থাকে সিক্ত ছায়াপথেরা...তাদের ঘুমোতে নেই।‌ আদিম বন্য জেগে থাকা চোখ অপলক চেয়ে থাকে‌ মহাকাশের ফসিলে।‌ পৃথিবীর বুকে তখনও যে-আলো এসে পৌঁছয়নি, তখন থেকে সে-চোখে অনল। বিরহনলে জেগে থাকা কস্তুরী-মণির মতো একজোড়া চোখ। 
কোনো মেহের আলির মতো চেঁচিয়ে নয়। নির্বাক দুইচোখের ভাষা প্রবলভাবে বলে চলেছে কত ইতিহাস পেরিয়ে..."জাগতে রহো...জাগতে রহো...জাগতে রহো...প্রেম আমার !"

সে-নির্বাক চোখের সুর রাখালিয়া বাঁশি‌ ছাপিয়ে ছড়িয়ে যায় জন্ম থেকে জন্মান্তরে, এক সভ্যতা থেকে আরেক সভ্যতায়, দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর, দীর্ঘতর থেকে দীর্ঘতম, অন্ত থেকে অনন্ত কোনো প্রতীক্ষায়... 
কাঞ্চনবর্ণ শরৎ-আলোর মতো দীপ্ত কোনো প্রেমের প্রতীক্ষায়...
তুমি বুঝেও বোঝো না গোঁসাই...নিদ্রাহীন কেন জেগে থাকে কস্তুরী-চোখ!

Comments