নিতাই ভট্টাচার্য

তারপর সারারাত জেগে থাকে কাশীরাম। সারারাত। আর ইচ্ছে যায় না বালিশে মাথা রাখার। বরং নিঝুম রাতে দুয়ারে বসে নিজের শৈশবের দিনগুলিতে ফিরে গিয়ে অনাবিল আনন্দ পায়। দুই চোখে ঘুম না-থাক, সংসারের "নেই-নেই" উৎপাত তো থাকে না; সেটাই-বা কম কী! তাছাড়া ঘুমের ভিতরেও দারিদ্র‍ উঁকি দেয়। তাই না-ঘুমিয়ে একা বসে থাকে, রোজ। ভালোলাগে কাশীরামের। 

ইদানিং রোজ রাতে একটা স্বপ্ন দেখে কাশীরাম। বিছানায় শুয়ে বালিশে মাথা রাখামাত্র স্বপ্নটা হাজির হয়। একটা সরু গভীর গর্তে পড়ে গেছে কাশীরাম। স্যাঁতস্যাঁতে। ঘন অন্ধকার। তার মধ্যে নড়তে-চড়তে পারে না। অজস্র পোকামাকড় কামড় দেয় গায়ে। বাঁচতে চেয়ে চিৎকার করে। ধীরে-ধীরে বুকের বাতাস ফুরিয়ে আসে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। চারপাশ থেকে গর্তটা সরু হয়ে চেপে ধরে কাশীরামকে, এইবার মৃত্যু নিশ্চিত; আর ঠিক সেই সময়ে ঘুমটা ভেঙে যায়। কেমন একটা ভয় বেশকিছু সময় জাপটে ধরে কাশীরামকে। আর ঘুমাতে ইচ্ছে যায় না। উঠে বসে বিছানায়। সারা শরীর ভিজে যায় ঘামে। বউ আর মেয়ে ঘরের মেঝেতে অঘোরে ঘুমায়। ওদের অচঞ্চল নিদ্রা দেখে মনে-মনে বড্ড খুশি হয় কাশীরাম। তখন দুয়ারে এসে বসে, শব্দ না-করে। পাশের ঘরেই কাশীরামের মা ঘুমায়। হাঁটাচলার শব্দে ঘুম ভেঙে যাবে। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে কাশীরাম। নয়তো উঠানে নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলে, হাত ধরাধরি খেলে, কখনো-বা দুইহাত দুইপাশে ছড়িয়ে দিয়ে ঘুরতে থাকে বনবন করে। এইভাবে বাকি রাত পার করে আনন্দ পায়। রোজ। রোজ।

আজও সেই স্বপ্নের দাপটে নিদ্রা ভেঙে ঝুরঝুরে হয়েছে। এই মুহূর্তে বেশ কিছুক্ষণ বিছানাতে বসে থাকে কাশীরাম। দু'চোখ বন্ধ। স্বপ্নে দেখা অন্ধকার গর্তটা ভেসে আসে মনে।
কেন যে এমন স্বপ্ন দেখে রোজ-রোজ! অফিসে চক্রবর্তীদা-কে জিজ্ঞাসা করেছিল বেশ কিছুদিন আগে। সবার আড়ালে। চুপিচুপি। "এমন স্বপ্ন কেন আসে?"
"এইসব হলো সময় খারাপ চলার সংকেত কাশীরাম। মানুষের জীবনে ভালো সময় একরকম সংকেত দেয়। আর খারাপ সময় অন্যরকম। তোর জন্মের সাল-তারিখ, সময়টা দিবি। জন্মছকটা দেখবো একবার।" গম্ভীর গলায় কাশীকে বলেছিল চক্রবর্তীদা।
অফিসের সবাই কম বেশি চক্রবর্তীদা-র পরামর্শ মেনে চলে। বাড়ি তৈরি, জায়গা কেনা, ফ্ল্যাট বুক, ছেলেমেয়ের কেরিয়ার—সবেতেই চক্রবর্তীদার মতামত অগ্রাধিকার পায়। শুধু তাই নয়, চক্রবর্তীদাকে দিয়ে জন্মছক তৈরি করিয়ে দামি-দামি পাথর ধারণ করে। তাতে দুঃসময় কেটে যায়। ভাগ্যের চাকা মসৃণভাবে বনবন করে ঘোরে। চক্রবর্তীদা নিজে পাথর এনে দেয়। সঠিক পাথর চিনতে পারে না সবাই, তাই। সেদিন অফিসের বড়েবাবু চুপিচুপি মেয়ে আর বউয়ের কুষ্টি তৈরি করিয়ে স্টোন নিল। ক্যাটস-আই আর পান্না। সাদা আলোর নিচে জ্বলজ্বল করছিল পাথরদুটো, নিজের চোখে দেখেছে কাশী। সেইসব দেখে কাশীরামেরও খুব ইচ্ছে হয় শান্তিতে বাঁচতে। মানে এমন একটা জীবন, যেখানে দোকানদারদের তাগাদা থাকবে না। মেয়ের টিউশন-মাস্টারের মাইনে থাকবে না। মায়ের, বউয়ের কোনো দাবি থাকবে না। এমন একটা পাথর ধারণ করবে, যাতে জীবনের সব অভাব দূর হয়ে যাবে মুহূর্তে; সুদিনের বাতাস বইবে সংসারে। তেমন পাথর যদি একটা পেত!

সবার চোখের আড়ালে একদিন নিজের মনের কথাটা চক্রবর্তীদা-কে বলেছিল। এই তো বেতন! সংসারে অভাব, অশান্তি। সারাদিন শুধু নেই আর নেই। কোনো পাথর নিলে যদি সুসময় আসে, সেই আশায় ডানহাতটা চক্রবর্তীদা-র টেবিলে পেতে দাঁড়িয়ে ছিল বেশ কিছুক্ষণ। "দূর-দূর, এইভাবে হয় না কাশীরাম! এইভাবে হয় না। জন্মের দিন-সময় ছাড়া কিছু বলা যায় না। তাছাড়া পাথরের দাম শুনলে মাথা ঘুরে যাবে তোর, কেনার ক্ষমতা..." 
আশাহত হয়ে ডানহাতটা তাড়াতাড়ি পকেটে পুরে নিয়েছিল কাশীরাম, কেউ দেখে ফেলবার আগেই। পরে বাড়ি ফিরে পুরানো পাঁজি, কাশীর বাবার পুরানো নথি খুঁজতে উদ্যোগী হয়েছিল। যদি কোথাও তার একমাত্র সন্তানের জন্মসময় লিখে রেখে যান কাশীরামের স্বর্গত পিতৃদেব। জন্মসাল, সময় পেলে স্টেশনের কালীদা-কে দেবে; যদি পাথরের পরিবর্তে শিকড় নিলে কাজ হয়। কালীদা বলে, "কাশীরাম অরজিনাল শিকড় কথা বলে! কত লোকের কত উন্নতি হলো এই শিকড়ে..."
না, পুরানো পাঁজি খুঁজে পায়নি। মাধবী-কে জিজ্ঞাসা করেছিল বাবার সেইসব কাগজপত্র পাঁজিপুঁতির কথা। স্বামীর কথা শুনে অবাক হয়েছিল মাধবী। "সে-সব কবেই বেচে দিয়ে প্লাস্টিকের মগ কিনেছি। বাথরুমে মগ ছিল না। তোমায় বলে-বলে হয়রান হয়ে গেছি; অগত্যা..."
এরপর কথা বললে অশান্তি হবে। চুপ করে গিয়েছিল কাশীরাম।
তারপর মা-কে জিজ্ঞাসা করেছিল, যদি কিছু মনে থাকে। কোন বছর বন্যা হয়েছিল, পালেদের তেঁতুলগাছে আগুন লাগলে কোন বছর, কালোগাইটা মোলো কোন বছর, নকুর পালের বউ পালালো কোন বছর—এইসব মনে আছে কাশীরামের মায়ের। শুধু মায়ের পেট ফুঁড়ে পৃথিবীতে কাশীরাম কবে এল, সেই দিনটার কথা মনে নেই! মনে-মনে ভীষণ রেগে গিয়েছিল কাশীরাম । সত্যি, মায়ের জীবনটাই জর্দাসর্বস্ব হয়ে উঠেছে! কথায়-কথায় শোনাবে, "কাশী, জর্দা নেই!"  

না, বিছানায় বসে থেকে সময় নষ্ট। তাছাড়া পাখার হাওয়াটাও ভীষণ গরম হয়ে গেছে। বদ্ধ ঘর। মেয়ে-বউ শুয়ে থাকে বলে, বাইরের দিকের জানালাটা বন্ধ থাকে। হাওয়া চলাচল হয় না। সন্ধ্যা থেকে একই বাতাস চক্কর কাটে ঘরের মধ্যে। জানালাটা খোলা রাখলে কী হয়? কে দেখতে আসছে রাতের বেলায়? তারচেয়ে বরং খোলা জানালা দিয়ে বাতাস আসবে, পাখাটা চালাতে লাগবে না। ইলেক্ট্রিকের বিলটা কম হয় কিছু। থাক, যা হচ্ছে হোক। গামছা দিয়ে গায়ের ঘাম মোছে কাশীরাম। নাইট ল্যাম্পটা জ্বলছে। হলদে আলোয় ঘরের সব কিছুই ম্লান দেখায়। আরও কিছুক্ষণ বসে থাকে কাশীরাম। বালিশের পাশেই রয়েছে মোবাইল-ফোনটা । বোতাম টিপে সময় দেখে। রাত বারোটা-দশ। কী করে হয়! রোজ এই একসময়ে ঘুম থেকে উঠে বসে! চক্রবর্তীদা হয়তো এর কারণটা বলতে পারবে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। বেশ কিছুটা জল ঢকঢক গলায় ঢালে। ঘুম ভাঙে মাধবীর। বলে, "যেটাই করবে, বাড়াবাড়ি। যেন যাত্রাপালা হচ্ছে! জল খাচ্ছে না চান করছে, কে জানে বাবা! একটা মুহূর্ত শান্তি নেই লোকটাকে..."
"ওঃ, মা!" তন্দ্রালু গলায় বলে মেয়েটা। 
"কাশী এলি! আমার জর্দা..." পাশের ঘর থেকে বলে কাশীর মা। 
"মাঝেমাঝে মনে হয় একবাটি জর্দা মুখে চেপে ধরি। আপদ মরেও না।" ভাঙাঘুম জোড়া লাগাতে চেয়ে পাশ ফিরতে ফিরতে বলে মাধবী।
"মা চুপ করো না।" মেয়ের কাতর অনুরোধ।
চুপ করে মাধবী। নয়তো শাশুড়ি-বউয়ের সান্ধ্যপালা শোনার পর মধ্যরাতে আরও একবার হাসবার সুযোগ পেত পড়শীরা।
বউ আর মায়ের কথা শুনে মনে-মনে দুঃখের হাসি হাসে কাশীরাম। কী বিচিত্র এই সংসার! সারা পৃথিবী অঘোরে ঘুমাচ্ছে। কাশীরামের সংসারে অভাব-অভিযোগ ঘোরাফেরা করে তখনও। কখন যে রাতটা গভীর হবে! 
খিদে পেয়েছে ভীষণ। কাল রাতে রাগারাগি করে না-খেয়েই শুয়ে পড়েছিল কাশীরাম। এখন সামান্য দুটো মুড়ি খেলে হতো। মুড়ি বোধহয় নেই। কাল সন্ধ্যাবেলায় অফিস থেকে বাড়ি ফেরামাত্র শুনিয়ে দিয়েছিল মাধবী। দু'ঢোক চা গলায় পৌঁছানোর আগেই শুরু হয় মাধবীর সঙ্গে কথা কাটাকাটি। বউয়ের কথার ফুলকি আগুন লাগিয়েছিল কাশীরামের মনে, ব্যস। তারপর আর জলস্পর্শ করেনি।
দুয়ারে এসে বসে নিঃশব্দে। পাশের ঘরে ঘুমাচ্ছে মা। জেগে উঠলেই উত্যক্ত করে মারবে। আজ কয়দিন হলো মায়ের জর্দা ফুরিয়ে গেছে। রাম বণিকের দোকান ছাড়া সে জর্দা আবার পাওয়াও যায় না! রাম বণিকের দোকানে মাইনে না-পেয়ে যাওয়া যাবে না; দুইমাস মুদিখানা মাল নিয়েছে ধারে। গেলেই হাজার কথা শোনাবে। শেষ কয়দিন ট্রেন থেকে নেমে ঘুরপথে বাড়ি ফেরে কাশীরাম। নয়তো বণিকদের দোকানের সামনে দিয়ে আসতে হয়। কাল স্টেশনের পানের দোকান থেকে পাঁচটাকার জর্দা এনে দেবে কাশীরাম। খেলে খাবি, নয়তো ফেলে দিবি। আর ভালো লাগে না!

বছরখানেক হল রাতে চোখে দেখে না কাশীরামের মা। এককথা সাতবার বলে। কাপের চা শেষ করেই নালিশ করে কাশীরামের কাছে, "তোর বউ আমার সঙ্গে কুকুর-শেয়ালের মতো ব্যবহার করে। সারাদিন একবেলা খাবার দেয় আর..." এতে মাধবীর মেজাজ গরম হয়। কথায়-কথায় বাড়ির বাতাস অশান্ত হয়ে ওঠে, অসহ্য লাগে কাশীরামের। 
মেয়েটা করুণ সুরে বলে, " আমাকে একটু পড়তে দেবে! সারাদিন চলছে!" 
অফিস থেকে ফিরে একদৃশ্য রোজ-রোজ। তখন মেয়ের আর্তি শুনে বউ আর মায়ের মুখের দিকে একবার তাকায় কাশীরাম। যুযুধান দুইপক্ষ। কেউ একপা পিছু হটবে না। মাঝখান থেকে ক্ষতি হয় মেয়েটার।

মেয়েটা বড়ো অদ্ভুত! বয়সের তুলনায় একটু বেশি গম্ভীর। সেভেনে পড়ে। পড়াশোনায় ভীষণ আগ্রহ। ঠিকমতো মাস্টার দিতে পারলে আরও ভালো হতো। সব সাবজেক্ট নিজে-নিজেই পড়ে নেয়। সমস্যা হয় ইংরেজিতে। একা পড়ে সামলাতে পারে না সবটা। চন্দন স্যারের কাছে একমাসের জন্য টিউশন পড়তে গিয়েছিল। মাসের শেষে মাইনেটা মেয়ের হাতে দিয়ে কাশী বলেছিল, "চারশো টাকা মাইনে! সামনের মাস থেকে মাস্টারকে দুশো কম নিতে বলিস।" বাবার কথার উপরে কথা বলেনি মেয়েটা। তারপর থেকে ইংরেজি টিউশন পড়তে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কাশীরাম অবশ্য জানত না সেকথা। একদিন অফিস যাবার পথে স্টেশনে চন্দন স্যারের সঙ্গে দেখা। স্যার নিজেই এগিয়ে এসে বলে, "মেয়েটা আর পড়তে আসছে না কেন? অত ভালো মেয়ে! কোনো সমস্যা থাকলে বলবেন, অসুবিধা হবে না।" 
"ক্যাজুয়াল স্টাফ আমি। কয়টা টাকা মাইনে পাই। ওকে যদি..." কথাটা কী করে যেন বলে ফেলেছিল কাশীরাম। পরে অবশ্য ভেবে দেখেছে, ভুল তো কিছু বলেনি। বিনেপয়সায় পড়ানো মন্দ নাকি? সেটাও সমাজসেবা। গ্রামের বিধু মাস্টার একসময় কত ছাত্রকে...
সেদিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরে মেয়েকে বলেছিল, "তোকে বিনেপয়সায় পড়াবে বলেছে চন্দন স্যার। কাল থেকে পড়তে যাবি।"
"তুমি বলেছিলে নাকি স্যার নিজে থেকে বলেছেন?" মেয়ের প্রশ্নের সামনে কুঁকড়ে গিয়েছিল কাশীরাম।
"আমি নিজেই পড়ে নেবো বাড়িতে। স্কুলে দিদিমণি বুঝিয়ে দেয়, ওতেই হয়।"
কী হয়, বোঝে কাশীরাম। যদি নিজে-নিজে হয়েই যায়, তবে হোক। চারশে টাকা কম নয়। অনেক।
মাধবী বলে, "কেমন বাপ তুমি? একটা বিষয়ের মাস্টারও দিতে পারো না!"
চুপ থাকে কাশীরাম। কী করে বোঝাবে উপার্জনের অবস্থা।
"বলেছি তো লাগবে না। আমি নিজেই পড়ে নেবে। তুমি চুপ করো মা। বাবা এই এল, সারাদিন পরিশ্রম..." বলে মেয়েটা।
মেয়ের কথা শুনে বুকটা ফাঁকা হয়ে উঠেছিল কাশীরামের। দিন-দিন মেয়েটা কেমন হয়ে উঠছে। ওর কথার অর্থ কেমন ধারালো মনে হয়। দৃষ্টি অন্তর্ভেদী। মেয়েটার যেন কোনো দাবি নেই কারও কাছে। যা পেয়েছে, যতটুকু আছে, তাতেই সন্তুষ্ট। কাশীরামের সংসারের সবার সাথে গা-লাগিয়ে বেঁচে থেকে এমন কঠিন ব্যতিক্রমী অভ্যাস আয়ত্ত করলো কীভাবে! আড়ালে মেয়ের কথা ভেবে অবাক হয়।

রাত গভীর হয়েছে আরও। উঠানে নেমে আসে কাশীরাম। ঘরগুলোকে তাকিয়ে দেখে। রাতের বেলায় কেমন জনমানবশূন্য অচিন দেশ বলে মনে হয় চেনা বাড়িটাকে। এই বেশ ভালো। রাতের অন্ধকারে ডুবে থাক ঘরবাড়ি উঠান পাঁচিল দুয়ার সব, সবকিছু। গভীর ঘুমে ডুবে যাক সংসারের মানুষজন। সারারাত নির্ঘুম রাত কাটাবে কাশী। এক অমেয় আনন্দ ছেয়ে আসে মনে। কাশীরামের বাড়িতে যেন সূর্যোদয় না-হয় কোনোদিন, মনেপ্রাণে চায় কাশীরাম। রাতের বেলায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সবাই, কারও কোনো দাবি থাকে না। কোনে রাগ নেই। বিবাদ নেই। কলহ নেই। অভাবের কঙ্কালটা মিলিয়ে যায় বাতাসে। "এটা নেই ওটা নেই" শুনতে-শুনতে ক্লান্ত কাশীরাম। মাথা তুলে আকাশটা দেখে। এই পৃথিবীতে একলা মনে হয় নিজেকে। এই আকাশ-বাতাস-গ্রহ-নক্ষত্র সবাই কাশীরামের আপন। ভালো লাগে। ছেলেবেলার কথা মনে আসে। নিজের দুইহাত দুইপাশে ছড়িয়ে আপন মনে বাচ্চাছেলের মতো উঠানে ঘুরপাক খায় কাশীরাম। মুখে বলে "আনি বানি জানি না..."। খুব মজা পায়। হা-হা করে হাসে খানিক। নিজেকে ভীষণ-ভীষণ সুখী মনে হয়। হাসতে-হাসতে হাঁপিয়ে গেছে কাশীরাম। এত হাসি অভ্যাস নেই। শেষ কবে এই বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে হেসেছে, মনে নেই।

রাস্তা থেকে একফালি আলো সদর দরজার ফাঁক গলে এসে পড়েছে উঠানে। সাদা কাপটা পড়ে রয়েছে ওইপাশে, দেখা যাচ্ছে। গতকাল অফিস থেকে ফিরে রাগে ছুঁড়ে ফেলেছিল কাপটাকে। কাপের দিকে তাকিয়ে থেকে থমকে দাঁড়ায় কাশীরাম। খেলা ভুলে কাপটাকে তুলে এনে দুয়ারে রাখে। আবার সংসারের কথা মনে আসে।
গতকাল অফিস যাবার সময় মাধবী একটা কাঁসার থালা আর বাটি আনার কথা বলেছিল কাশীরামকে। রবি ব্যানার্জির নাতির অন্নপ্রাশন। "জিনিস দুটো সঙ্গে নিয়ে ঢুকবে বলছি, নয়তো..."
"আমার জর্দা আনবি কাশী।" বলেছিল কাশীরামের মা। মেয়েটা কী একটা বলতে গিয়ে থেমে গিয়েছিল, মা আর ঠাকুমার দাবির পর আর কিছু বলা ঠিক হবে না হয়তো, তাই। সত্যি এই সংসারে এমন মেয়ে!

স্টেশনের দিকে হাঁটা দিয়েছিল কাশীরাম। মেজাজ বিগড়ে দ্বাদশীর চাঁদ। কাঁসার থালা আনবে! মামাবাড়ির আবদার। কাঁসার থালার যা দাম! মাইনে যা পায়, তাতে অর্ধেক মাস গেলেই কাশীরামের পকেট ফাঁকা। তখন অফিসের সুবলদা নয়তো অসীমদার কাছে হাত পাতে। টাকা ধার নেয়। কিছু টাকায় সংসার টানে, বাকি টাকায় কিছুটা ধার শোধ করে মান রক্ষা করা। এর টাকা নিয়ে ওর ধার শোধ করে, আবার পরের মাসে ওর টাকা নিয়ে এর ধার। এ যেন একটা খাল কেটে সেই মাটি নিয়ে অন্য খাল ভরাট করা! অসীমদা আর সুবলদা দু'জনই বোঝে কাশীরামর অবস্থা; মুখে বলে না কিছু। 
আজ ওদের দুজনের কেউ আসেনি। টাকা ধার দেবার লোক ছিল না অফিসে। কাশীরামের পকেটেও টাকা নেই। ট্রেন থেকে নেমে কুণ্ডুদের বাসনের দোকানে ঢুকতে গিয়েও পায়ে লাগাম টানে। মাসকয়েক আগে বাড়িতে লক্ষ্মীপুজোর জন্য পিতলের ঘটি কিনেছিল, ধারে। সে-পয়সা আজও দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়নি মানে, দেয়নি। ফলে গতকাল খালিহাতেই বাড়ি ফিরেছে। তারপর...

দুয়ারে উঠে আসে বসে কাশীরাম। গতকালকের কথা মনে পড়ে যায়। তাড়াতাড়ি উঠানে নেমে আসে আবার। নয়তো গতকালকের মতে আজকের রাতটাও মাটি হয়ে যাবে। গতকাল উঠানে একা-একা হেসেখেলে ক্লান্ত হয়ে গিয়ে দুয়ারে বসে ছিল। দু'পা সামনে ছড়িয়ে। সশব্দে হাই তোলে। ঘুম ভেঙে যায় কাশীরামের মায়ের। ব্যস, সারা রাত বকরবকর। হাজার-হাজার অভাবের কথা। রাত জাগাটাই বৃথা গেল! আজ আর দুয়ারে বসবে না কিছুতেই। উঠানে পায়চারি করে কাশী। কী করা যায়? সদর-দরজার সামনে একটি লাঠি পড়ে আছে। তুলে নেয় কাশী। বাঁইবাঁই করে লাঠিটা বাতাসে ঘোরায়, যেন তরবারি। নিজের ছায়ার সঙ্গে ভীষণ যুদ্ধ করে তলোয়ার উঁচিয়ে। ঐতিহাসিক যাত্রাপালার সংলাপের মতে বলে, "দিনের আলো আসিতে নাহি দিব এ সমরাঙ্গনে আমি। চিরনিশি বিরাজিবে হেথায়। আঁধারে অভাবের নাহি স্থান আমার সংসারে। সুখ সুখ আর সুখ।" বলে হা-হা-হা করে একটানা হেসে চলে কাশীরাম। কী করে যেন বলে ফেললো ডায়লগটা! কোথায় শুনেছিল কে জানে! না, এইবার খুব ক্লান্ত লাগছে। না-বসলেই নয়। খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে কাশী। হঠাৎ অভিমন্যু-বধ যাত্রাপালার একটা সংলাপ মনে আসে। উঠানের মাঝে গিয়ে আবার দাঁড়ায় কাশী। তর্জনী সোজা রেখে ডানহাতটা আকাশের দিকে তুলে দেয়, যেন সুদর্শনচক্রধারী শ্রীকৃষ্ণ। ভীষণ ক্রোধ নিয়ে গলার স্বর সামান্য উপরে তুলে কাশীরাম বলে, "যাও, যাও সুদর্শন আঁধারে ঢেকে রাখো আলোকময় এই পৃথিবীকে, অরি সংহার ..." তারপর চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকে, ভুলে গেছে সংলাপটা। ইস, এইসময়েই ভুলে গেল! ভাবতে চেষ্টা করে বেশ কিছুক্ষণ ধরে। কিছুতেই মনে আসে না। হঠাৎ করে কে যেন পিছন থেকে বলে, "ওঃ সারারাত ঘুম নেই চোখে, শুধু যাত্রাপালা হচ্ছে!" কাশীরামের বউ উঠেছে। সেই রাত থেকে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল কাশীরাম। পুব-আকাশে কখন যে রঙ লেগেছে, খেয়াল করেনি। বউকে দেখে লজ্জা পায় কাশীরাম, দুঃখও পায়। রাতটা শেষ হয়ে গেল এতো তাড়াতাড়ি!
"ঘরে চা-চিনি কিছুই নেই। উনি উঠলেই তো চা দিতে হবে। আজ কিন্তু গরম জল দেবো, বলে দিলাম।" শাশুড়িকে উদ্দেশ করে বলে মাধবী।
"ও বউ, উঠলি? কত বেলা হলো, আবার কখন চা দিবি! ও কাশী, পইপই করে বললুম আমার জর্দা..."
শঙ্খ বেজে ওঠে। উলুধ্বনি শোনা যায়। রবি ব্যানার্জির নাতির পৈতে আজ, ভোরের মঙ্গলানুষ্ঠান শুরু।
"মরণ! অতবার করে বলেছিলাম কাঁসার থালা..." বলতে থাকে মাধবী। 
সূর্যোদয়ের সঙ্গে-সঙ্গে বাস্তবের কঠিন জমিতে আছাড় খায় কাশীরাম। নিদ্রাহীন সুখের রাত কাটিয়ে উঠানের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে চুপ করে। দিনের আলো ফুটেছে, কাশীরামের সংসার জেগে উঠেছে। অভাব, অভিযোগ, উপেক্ষা, যন্ত্রণা, বিবাদ, তর্ক-বিতর্ক একে-একে মাথাচাড়া দেবে এইবার। দারিদ্রের কঙ্কালটাকে দেখা যাচ্ছে একটু একটু করে। সেই লাঠিটা আবার লাঠি হয়ে পড়ে রয়েছে উঠানে। সেটাকে তুলে নিয়ে একপাশে রেখে দেয়, রাতের বেলায় কাশীরামের হাতের তরবারি হয়ে উঠবে আবার। একটা বড়ো শ্বাস নেয় কাশীরাম। আবার দীর্ঘসময়ের অপেক্ষায় থাকবে। দিন ফুরিয়ে রাত আসবে। সংসারের সুখের স্বাদ নেবে কাশীরাম সারারাত নিদ্রাহীন থেকে। রাতের সংসারেই কাশীরামের সুখ। সে এক অন্যরকম সুখ!

Comments