সমরেন্দ্র মণ্ডল

"আয় বৃষ্টি ঝেঁপে/ ধান দেবো মেপে"—নাঃ, ঝেঁপে বৃষ্টি তেমন আর হলো না।  কাল থেকে চলছে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। এই বৃষ্টিতে ইলিশ মাছের আমদানি কম হয় না। রোজই শুনি ডায়মন্ড হারবারে নাকি টন-টন ইলিশ উঠছে। তা উঠুক। বাজারে এলেই হয়। আসছে কি আর না? আসছে। কিন্তু দামের কথা শুনলেই গায়ে ছ্যাঁকা দিচ্ছে। মধ্যবিত্তের পকেটে টান। নিম্নবিত্তরা পকেট চেপে ধরে ইলিশের দিকে তাকাচ্ছে। আহা, তাকানোতেই কী সুখ!

একটা পুরোনো কথা মনে পড়লো। আমাদের হাফপ্যান্ট আর ডাংগুলি খেলার বয়সে বাড়িতে আসা খবরের কাগজে একটা ব্যঙ্গচিত্র দেখেছিলাম। এই বুড়োবয়সেও বেশ মনে আছে। একটা লোক ভাত খাচ্ছে, সামনে সুতো দিয়ে ঝোলানো একটুকরো মাছ। অর্বাচীনের কথাটা মনে পড়তেই ফিকফিক করে হেসে ফেললো। ভ্যালা রে ভ্যালা, এখন নিম্নবিত্তের ওই অবস্থা। একটুকরো ইলিশ তরকারির ঝোলে চুবিয়ে নিয়ে সুতো দিয়ে বেঁধে সামনে ঝুলিয়ে রাখো, আর ওই ঝোল দিয়ে চারমুঠো ভাত সেঁটে দাও।

কিন্তু তা কী হবার জো আছে বাপ! বউ তো ইলিশ খাবার বায়না ধরেছে। অর্বাচীন ভাবলো কী করা যায়। হুঁ-হুঁ বাবা, বুদ্ধি থাকলে উপায় হয়। অর্বাচীন তো আর জগা পাগলা নয়। তা অর্বাচীন গেল ইলিশ কিনতে। এই বাদলের দিনে গিন্নির সাধ হয়েছে ইলিশ মাছ দিয়ে ভুনা খিচুড়ি খাবে। থলি হাতে ঝুলিয়ে রাজার মতো বাজারে চললো অর্বাচীন।
বাজারে ঢুকে একচক্কর মেরে এক ইলিশ-ব্যাপারির সামনে দাঁড়ালো, ইলিশ কত করে?
— বাবু জলের দর বাবু, বারোশো।
— কত হবে, ওজন?
— এই বাবু চার-পাঁচশো।
— একটু বড়ো নেই?
— এই তো বাবু, এক কেজির একটু ওপরে। দেবো বাবু একটা?
— কত করে দিচ্চ?
— মাত্র আঠারোশো। দিই বাবু একটা?
— বাজারটা করে এসে নিচ্ছি।
অর্বাচীন হাঁটা লাগালো। ঘুরতে-ঘুরতে এক বিক্রেতার সামনে দাঁড়ালো। 
— মাছ কত?
— সাড়ে-চারশো বাবু।
— হুঁ। দেখতে তো বাবা ইলিশের মতোই। কিন্তু ইলিশ তো নয়।
— চন্দনা, বাবু। এ ইলিশেরই জাত। খুড়তুতো ভাই বলতে পারেন।
অর্বাচীন দেখলো গোটা-গোটা চোখ চেয়ে চন্দনা বলছে, ও ভ্যালা উঠবো নাকি থলিতে? তোমার বউ কিস্যুটি টের পাবে না।
— দেবো?
 — তোলো পাঁচশো মতন।
ইলিশের বিকল্প চন্দনা থলিতে ভরে গর্বিত স্বামীর মতো বীরদর্পে হাঁটা দিল একটা সিগ্রেট ধরিয়ে।
উত্তর কলকাতায় বড়ো হওয়া, কোনোদিন বাজার না-দেখা গিন্নি খিচুড়ি সহযোগে চন্দনা উদরসাৎ করে একটা লম্বা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছিলেন।

হ্যাঁ, আসল-নকল। এই আসল-নকলের দ্বন্দ্বেই দিন কেটে যায়। অর্বাচীন ভাবে। ভাবতে-ভাবতেই দিন কেটে যায়।  দার্শনিক হয়ে যায়। উদাস হয়ে যায়। এই যে প্রকৃতি, এরও কি আসল-নকল আছে নাকি ? তা কী করে হয়! প্রকৃতি তো আদি-অকৃত্রিম। সৃষ্টির সময় থেকেই তো প্রকৃতি অনন্ত। তার তো নকল হতে পারে না। ওই দ্যাখো। অর্বাচীনের মগজে ঢংঢং করে ঘণ্টা বেজে উঠলো। আরে ক'দিন আগেই তো কাগজে পড়েচে, কোথায় নাকি কৃত্রিম বৃষ্টিপাত করে চাষের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তা বৃষ্টি যখন কৃত্রিম, তখন মেঘও নিশ্চয়ই কৃত্রিম। দেকেচো? মানুষ পারে না মানে? সব পারে। নকলের প্রধান শিক্ষক। এই যে ওষুধ। কত নকল ওষুধ যে বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আমরা কি তা জানি? সরকার মাঝেমাঝেই ধরে, আবার ধরেও না। ধরতে-ধরতেই দশটা নকল বেরিয়ে যায়। ল্যাও ঠ্যালা।  যারা ধরতে আসে, তারা নকল নয় তো?

অর্বাচীনের মগজে টরেটক্কা টরেটক্কা করে প্রশ্নপত্র ছাপা হয়ে গেল। আচ্ছা, আপনি একটু আগে যে-লোকটার সঙ্গে কথা বললেন, তিনি নকল নয় তো? উদাহরণ-সহ আলোচনা করুন। বড়ো আতান্তরে পড়লো অর্বাচীন। তা আবার হয় নাকি! হয়-হয়, জানতি পারো না। আচ্ছা, মানুষ নকল দাঁত নিয়ে ঘোরে। নকল হাসি। অনেকের হাত-পা কাটা গেলে, নকল হাত-পা দেওয়া হয়। ভাবতে-ভাবতেই অর্বাচীনের মস্তিষ্কের কোষগুলো লাফিয়ে উঠলো। আঃহা, রোবট। মানুষের মতো দেখতে রোবট বাজারে বেরিয়ে গেছে। তারা হোটেলে, বাড়িতে কাজ করছে। কাগজে একটা ছবি দেখেছিলও বটে। কথাটা মনে হতেই অর্বাচীনের মনে প্রশ্ন জাগলো— আচ্ছা, আমি নকল নই তো!

Comments