অর্বাচীন ক্রমশই দার্শনিক হয়ে উঠছে। তার জীবন যত এগিয়ে যাচ্ছে, দার্শনিক-বোধও তত তীব্র হচ্ছে। এই যেমন তার মগজে ঢুকেছে 'বাসা বদল'। যাদের নিজস্ব বাসস্থান এখনও গড়ে ওঠেনি বা গড়তে পারেনি, তাদের তো সময়ান্তরে বাসা বদল করতেই হয়। এক পাড়া থেকে ভিন্ন পাড়া অথবা এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চল। কয়েক বছর বাস করার ফলে এলাকার মানুষের সঙ্গে যে-সখ্য নির্মিত হয়, তা কয়েক ঘণ্টা ব্যবধানে ছিন্ন হয়ে যায়। সত্যিই যায় কি? হয়তো যায়, অথবা যায় না। সব পুরাতনই তো আর জীর্ণ হয় না! অতএব সব পুরাতন ভেসে যায় না। হৃদয়ের ভিতরে যে-টান তৈরি হয়, তা কি খণ্ডসময়ে ভেসে যায় নাকি ভেসে যেতে পারে!
এই বোধে জারিত হতে-হতেই অর্বাচীন দিব্যচক্ষে দেখে ফেলে জীবনের বাসা বদলের দৃশ্য। ওই যে সেক্ষপীয়রের একটা সংলাপ বেদবাক্য হয়ে আছে, "পৃথিবীটা একটা মঞ্চ আর আমরা সবাই অভিনেতা"। এটাই তো হক কথা। জীবনের একটা উইংস দিয়ে ঢোকো, সংলাপ বলো, যা-যা করার করে নাও, পর্ব শেষ হলেই অন্য উইংস দিয়ে প্রস্থান করো।
এই তো জীবন কালীদা!
এই তো জীবন কালীদা!
এই দার্শনিক-বোধ থেকেই অতীতে একবার চক্কর মেরে নেয় অর্বাচীন। সেও তো একসময় বাসা বদল করতো। এক-এক বাসার এক-একরকম নকশা। বাড়ি এবং ঘরের আকৃতিও ভিন্ন। সে ভাবে, মানুষের কী অসীম সহনশক্তি! তাকে যেখানে যেভাবেই রাখো, ঠিক মানিয়ে যাবে। এই দ্যাখো না, এক সরকার থেকে অন্য সরকার এলে তুল্যমূল্য বিচার না-করেই নাছোড়, ত্যাঁদড় ভাড়াটের মতো সরকার আগলে রাখতে চায়। এদিকে ঘর যে ভেঙে পড়ে গেল, সেদিকে হুঁশ নেই।
বাসা বদল নিয়েও কত কিস্সা। এই যে মানুষ মাথা গোঁজার জন্য এক বাসা থেকে অন্য বাসায় যায়, তার আগে তাকে কত কিছু জরিপ করতে হয়। কী দ্যাখে? না, তার পরিবারের সদস্যসংখ্যা অনুযায়ী আসবাবপত্রের স্থান সংকুলান হবে কিনা এবং তাদের সুবিধা-অসুবিধা ইত্যাদি প্রসঙ্গ। সঙ্গে থাকে বাসা-মালিকের নানাবিধ শর্ত। মানতে পারলে এসো, না-মানতে পারলে অন্য পথ দ্যাখো। আর যিনি বাসা খুঁজছেন, তাঁর হয়তো বাসা পছন্দ হয়েছে; কিন্তু মালিকের শর্ত বড্ড বেয়াড়া। তখন তিনি নিজেকে বললেন, "মামদোবাজি, টাকা নেবে এককাঁড়ি, আর ফালতু শর্ত দেবে? আদিখ্যেতা আর ধরে না! ধুউউউউউস্।"
পৃথিবীতে যেমন বাসা আছে, তেমনি বাসাহীনতার গল্পও তো কম নেই। এমন কত গল্প তো ছড়িয়ে আছে আমাদের চারপাশে। এই তো একটা খবর ছড়িয়ে পড়েছে মুঠোফোনে। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ বলে প্রচারিত ম্যারিকার একটা অংশে, আলোর আড়ালে রয়ে গেছে দারিদ্র্যের হাহাকার। মানুষ বাসা হারিয়ে পথে বাস করছে। ভাঙা, পরিত্যক্ত গাড়ির ভিতর রাত্রিযাপন করছে। এদের ঠিকানা নেই, ফলে ইচ্ছে থাকলেও কাজ পায় না। পেট চলে ভিক্ষে অথবা অন্ধকারের পেশায়। সমাজের দাগি আসামিরা এদের মাঝেই লুকিয়ে থাকে।
আমাদের দেশেও কি এমন উদাহরণ নেই? আছে। একটু নিবিড় অনুসন্ধান করলেই বহু কাহিনি বেরিয়ে আসবে ঘটিবাটি নিয়ে। এই তো অমুকবাবুর কথাই ধরুন, তিনিও তো এককালে বিত্তশালী ছিলেন। কলকাতার অদূরেই তিন কি চারপুরুষের বিশাল অট্টালিকা ছিল। একটি নয় দুটি। দুটিই তিনতলা। সঙ্গে প্রায় কাঠা আটেক জমি। এই তিন-চার প্রজন্মে পরিবারের সদস্যসংখ্যা এখন পঞ্চাশের বেশি। সব যে-যার মতো ছড়িয়ে পড়েছে। তারা সকলেই প্রতিষ্ঠিত। শুধু অমুকবাবু ভিটে আগলাচ্ছিলেন একটি বাড়ির এক খণ্ডে। বাড়িগুলো সংস্কার হয় না। ভগ্নদশা। লোকে বলে, ভূতুড়ে বাড়ি। তা সেই ভূতুড়ে বাড়িতেই ভূতের মতো বাস করেন তিনি স্ত্রী-কন্যা নিয়ে। বেসরকারি দপ্তরে বছর-বছর বেতন বৃদ্ধি না-হওয়া চাকরি করে এই দুই প্রাসাদের খাজনা-সহ সমস্ত বন্দোবস্ত টিকিয়ে রাখা মুশকিল বইকী।ঠিক এইসময় বাড়ি দুটোর উপর চোখ পড়লো প্রোমোটারের। শুরু হলো যোগাযোগ। কোনো এক শরিক বিদেশে বসেই দায়িত্ব নিয়ে বিক্রির ব্যবস্থা করলেন। বাকি ব্যবস্থা কয়েকমাস ধরে প্রোমোটারের লোকজন করে ফেললো। অমুকবাবু এসব টেরটি পেলেন না। একদিন প্রোমোটারের লোকজন তার হাতে নগদ কিছু দিয়ে বাড়ি ছাড়ার হুকুম করলো। তিনি দেখলেন, সকলেই সই দিয়েছে। বাধ্য হয়ে তাঁকেও সই করতে হলো। তাঁর ব্যাঙ্কে আরও কয়েক লাখ পড়ার কথা। বছর ঘুরতে চললো, এখনও ঢুঁ-ঢুঁ। প্রাসাদ ছেড়ে এখন তিনি শহরের অদূরে একটা টালিছাওয়া ছোটো বাড়ির ভাড়াটে।
অর্বাচীন শ্বাস ফেলে। নাতিদীর্ঘ। নিজেকে শুনিয়েই বলে, "সকলই গরল ভেল"।
Comments
Post a Comment