সমরেন্দ্র মণ্ডল

অনেকদিন পর আবার জগা পাগলার সঙ্গে দেখা হলো। বিজয়ার আমেজ তখনও কাটেনি। বউয়ের মুখঝামটা খেয়ে প্রচণ্ড বিরক্তিতে হাতে মিষ্টির প্যাকেট ঝুলিয়ে চলেছে কুটুম্বিতা করতে। বিরক্তি তো হবেই। একে গ্যাঁট খরচা হচ্ছে, তার উপর সময় নষ্ট। এই সময়টুকু সে দুটো কথা ভাবতে পারতো। তা নয়, প্রথমে বউয়ের অনুরোধ, তারপর মুখঝামটা খেয়ে এখন ব্যাজার মুখে চলেছেন বউয়ের সইয়ের বাড়ি। কোন এককালে মেয়ের ইস্কুলে আলাপ, এখনও প্রেম গদগদ। হাঁটছে আর ভাবছে, অর্বাচীন না-হলে এমন খিদমত খাটতে হয়!

হাঁটছে অর্বাচীন। হাঁটছে। এমন সময় মুখোমুখি জগা।
—কী অর্বাচীনবাবু, কেমন আছেন?
আঁতকে ওঠে  অর্বাচীন। চোখ গোটা-গোটা করে জগার দিকে চেয়ে থাকে। মুখ থেকে শব্দ ছিটকে আসে, জগা!
—হ্যা-হ্যা, আমি। অবাক হলেন নাকি?
অর্বাচীন চশমাটা নাকের উপর ঠেলে ভালো করে দ্যাখে। একবার সে জগাকে দ্যাখে, একবার নিজেকে। মানে, জগার মুখটা সে হয়ে যায় বা তার মুখটা জগা হয়ে যায়। প্রায় ভিরমি খাবার উপক্রম হলো অর্বাচীনের। কোনোরকমে সামলে নিয়ে বলে, ভালো। তা তোমার খবর কী?
—হ্যা-হ্যা, এই আচি। আপনাদের দেকতে এলুম। কদ্দিন দেকিনি তো।
—দ্যাখার কী আছে? অ্যাঁ? দ্যাখার...
—এই যে আপনি বউয়ের গুঁতো খেয়ে বিজয়া কত্তে চললেন। হাজার হলেও তো বউয়ের সই। বরং ওই বাঁজা বিধবা শালির বাড়ি যেতে বললে এক্কেবারে ডগোমগো হয়ে উঠতেন।
—মুখ সামলে কথা বল জগা। নইলে...
—নইলে আপনি কিস্যু কত্তে পারবেন না। আপনিও অর্বাচীন, আমিও অর্বাচীন। আর গায়ে হাত তুলতে গেলেই ফুস। আমি তো এখন বাতাস। মাঝেমধ্যে আপনার ভিতর সেঁধিয়ে যাই। এই যেমন একটু আগেই সেঁধিয়ে ছিলাম। আপনি মান্যগণ্য সরকারি বাবু ,আর আমি এইট ফেল। তফাৎটা কী হলে? আমিও যা, আপনিও তাই। তা পুজো কেমন কাটালেন দাদুউউউ?
রাগে গরগর করতে করতে উত্তর দিল, ভালো।
—ভালো আর কী করে হলো মশয়? ডিএ তো পেলেন না। কোর্টে ঝুলছে।
জগা যেন ওর গোপন জায়গায় হাত বুলিয়ে দিল। বিষণ্ণ স্বরে বললো, হ্যাঁ, রিটায়ার্ড লাইফে দুটো বাড়তি পয়সা পেলে মন্দ হতো না। আর পেয়েই বা কী হতো! সেই তো বউয়ের বায়না বাড়তো।
হ্যা-হ্যা করে হাসতে লাগলো জগা। হাসতে-হাসতে পেটে খিল লাগার জোগাড়। অর্বাচীনবাবু ভ্যাবাচ্যাকা মেরে গেল। তারপর  গলা উঁচিয়ে জিগ্যেস করলো, হাসার কী হলো অ্যাঁ? হাসার কী হলো?
—হাসবো না? বুড়ো বয়সে কোথায় এট্টু ধম্মকম্ম করবেন, তা নয়; কেবল টাকা-টাকা! আরে মশয় আপনাদের এট্টু বেশি ধম্ম করার জন্যেই তো গবমেন্ট একগাদা টাকা দিচ্ছে।
— দিচ্ছে তো দিচ্ছে। তাতে আমার কী এল-গেল?
জগা বুঝতে পারলো এবার মিসফায়ার হয়ে গেছে। সে মাথা চুলকে, পেট চুলকে মিনমিন করে বললো, তা অবিশ্যি ঠিক। আমাদের কলা হলো।
 —পথ ছাড় জগা। 
 —যান, বউয়ের বায়না রাখতে যান। বিধবা শালির বাড়ি তো আর যেতে পারলেন না! যান, বউয়ের সইয়ের বাড়িতে ভুঁড়ি নাচিয়ে যান।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জগা—ভুস। অর্বাচীনও পা চালালো। যেতে-যেতে ভাবে, আমাদের ছোটো কেন বড়োবেলাতেও এমন মিষ্টির প্যাকেট ঝুলিয়ে এবাড়ি-ওবাড়ি করার রেওয়াজ ছিল না। ওরা ঘরে তৈরি নাড়ু, নিমকি আর ঘুগনির লোভে নিজেরাই বাড়ি খুঁজে-খুঁজে হানা দিত। প্রতিবেশীদের বাড়ি নাড়ু, নিমকি, খই, মোয়া, সন্দেশ দিয়ে আসার সময় দুটো চিনি বা তিলের  নাড়ু আর নারকেলের সন্দেশ খেয়ে আসতো। আর ছিল প্রণাম। বড়োদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে আশীর্বাদ নেওয়ার মধ্যে কোনো হীনমন্যতা ছিল না। আর এখন? হাঁটু পর্যন্ত হাত বাড়াতেই কোমরের খিল খুলে যায়!
অর্বাচীন হাঁটে আর ভাবে। ভাবে আর নিজের উপর রেগে যায়। আর তখনই তার ভিতরে জগা বলে ওঠে, গোল্লা, সব গোল্লা।

Comments