শর্মিষ্ঠা ঘোষ

তখন পাঁচ পয়সায় লালরঙের একটা কাঠিবরফ আর দশ পয়সায় নারকেল দেওয়া সাদা বরফ পাওয়া যেত। এটা নাকি দুধবরফ। যদিও আমি জানতাম, সব বরফ‌ই ড্রেনের জলে তৈরি। পরে ভেবেছি, কলের জলে কেন নয়! রোগাসোগা একটা আখের দাম কুড়ি পয়সা। ছোটো সন্দেশ পঁচিশ পয়সা। দশ পয়সার সাদা শোনপাপড়ি এবং গোলাপি বুড়ির চুল। কাচের বাক্স গলায় ঝুলিয়ে আমাদের মহিলা সমিতি স্কুলের সামনে বসে থাকতো শোনপাপড়ি-দাদু। হাতে ঘন্টা। এই বুড়োবয়সে জেনেছি, ওই বুড়ির চুলের আসল নাম হাওয়াই মিঠাই। ক্যান্ডি ফ্লস। আর ছিল কাচের বয়ামে‌ তেলে চোবানো গোটা-গোটা জলপাই‌ আর তেঁতুলের একটা গোলা-গোলা আচার। সে-সবও ওই পাঁচ পয়সা করেই।

আমাদের সেই প্রাইমারি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, অভিনেতা নিমু ভৌমিকের মা। মহিলা সমিতি স্কুল। ড্রেস ছিল অরেঞ্জ শার্ট ব্লু টিউনিক বা স্কার্ট। ছেলেদের অরেঞ্জ শার্ট ব্লু প্যান্ট। এই মহিলাকে সবাই বৌদি বলে ডাকতো। আমিও দেখেছি কয়েকবার। সাদা পাড়হীন সুতির শাড়ি ঘরোয়াভাবে পরা। বিধবা। একটু পৃথুলা। স্কুল আসতেন বিশেষ দিনটিনে। পরবর্তীকালে মহিলা সমিতি স্কুল দুপুরে শিফট করে। সরকার-পোষিত স্কুলে পরিণত হয়। যার প্রধান হলেন ইলা কর্মকার দিদিমণি। আর সকালের সেকশনটার নাম হয় সম্ভবত ভগিনী নিবেদিতা। ওটা প্রাইভেট। ওটার হেড চপলা দিদিমণি। তিনি আবার মহিলা সমিতির সেলাই দিদিমণি। আমার বম্মা মানে বড়োজেঠিমা তাঁর কাছে ছাঁটকাট শিখেছিলেন। আমার ছোটোবেলার অধিকাংশ জামাই কাপড় কিনে বম্মার হাতে বানানো।

আমি কেজি ওয়ান, টু সকালের সেকশনে পড়ে ক্লাস ওয়ান থেকে চলে এলাম ফ্রি-প্রাইমারিতে। দুপুরের শিফটে। আমার কাজিন শঙ্কু আমার সঙ্গেই সকালে পড়তো। ও চলে গেল মিলনপাড়ায় নির্মল নন্দীর প্রাইমারি স্কুলে। আমার টিফিন ছিল স্টিলের টিফিনবক্সে বিস্কুট, রুটি, বেগুনপোড়া, ছানা বা আপেল। বাঁধাধরা টিফিন। ভুলেও হাতে পয়সা দিত না বাবা-মা। সকালের স্কুলে প্রথমে ঊষামাসি, তারপর দুপুরের স্কুলে মায়ামাসি আমাদের কয়েকজনকে স্কুলে নিয়ে যেতেন হাঁটিয়ে-হাঁটিয়ে। দু'জনেই বিধবা। সরুপাড় সাদা সুতির শাড়ি ঘরোয়াভাবে পরা। ঊষামাসি বেঁটে। মায়ামাসি লম্বা। দু'জনের হাতেই থাকতো সরু বাঁশের কঞ্চি। যেভাবে "রাখাল গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে।" এখন যেটা রায়গঞ্জ জজকোর্ট, সেই মাঠ তখন খোলা। কঙ্কা দিদিমণির বাড়ির উল্টোদিক দিয়ে ঢুকে সেই মাঠের ওপর দিয়ে হেঁটে পৌঁছাতাম এখন যেটা ঘড়িমোড়, সেখানে। কঙ্কাবতী লাহিড়ী আমার মর্নিং সেকশনের টিচার। তাঁর বাবা কংগ্রেস মন্ত্রীসভায় মন্ত্রী ছিলেন। ওই মোড়ের একদিকে কয়েকটি টিনের ট্রাঙ্ক বানানোর দোকান। তখন গোদরেজ আলমারি রেয়ার ব্যাপার। লোকজন হয় কাঠের আলমারি নয় টিনের ট্রাঙ্ক ব্যবহার করতো জামাকাপড় বা ভ্যালুয়েবলস রাখার জন্য। আমার আম্মা মানে ঠাকুমারও একটা টিনের ট্রাঙ্ক ছিল। তাতে থাকতো দুটো তোলা পুরো ধবধবে সাদা থান, সুতির ব্লাউজ, একটা সাদা শাল, খাপশুদ্ধ চশমা আর দু-একটা ম্যাগাজিন। আম্মার যৎযাবতীয় সম্পত্তি বলতে এই। তো, সেই ট্রাঙ্কের দোকান ছিল ভৌমিকবাড়ির। ভৌমিকবাড়ির বড়ো মেয়ে স্কুলে আমার সিনিয়র। মোড়ের আরেকদিকে কয়েকটি ফলের দোকান। ছিল গণেশ ক্লথ স্টোর্স এবং দাশ অপটিক্যাল। তখন অবশ্য এখন যাঁরা বসেন দোকানে, তাঁদের বাপ-পিতামহ দোকানদারি করতেন। 

এই ফলের দোকানের সামনে একবার একটা মজার ঘটনা ঘটে। আমরা তখন ওয়ান-টুতে পড়ি। উকিলপাড়ায় একটি বাড়িতে সম্ভবত টুকুপিসির বিয়ে। আমরা রেললাইন পেরিয়ে হেঁটে-হেঁটে যাই-আসি। তার বিয়ের নেমন্তন্ন খেয়ে আমরা ফিরছি বিশাল দল। সেই দলে আছে আমার মা ছাড়াও আমার দুই জেঠিমা এবং ছোটোকাকিমা, আমরা জনাপাঁচেক কাজিন। আমাদের হাইয়েস্ট বয়স হয়তো সাত-আট, লোয়েস্ট দুই-তিন। ভাই কোলে। আঙুর কেনার জন্য এই ফলের দোকানের সামনে আমরা দাঁড়িয়েছি। হঠাৎ দেখি খালি গা, মাথায় লাল ফেট্টির মতো গামছা বাঁধা, হেটোধুতি হাঁটুর উপর কাছা মেরে পরা, সারাগায়ে চকচকে তেল মাখা এবং হাতে জ্বলন্ত মশাল—কতগুলো লোক দৌড়ে যাচ্ছে রেল কলোনির দিকে। ওদিকটা তখনও অন্ধকার। ফলের দোকানে কুপি আর হ্যাজাকের আলো। এই মোড়টুকু পেরোলেই লাইন। সে-সব পেরিয়ে ঘন অন্ধকারে তারা হাওয়া হয়ে গেল। লোকজনের কথাবার্তায় জানতে পারলাম, সামনেই দুর্গাবাড়ি। আসলে দুর্গা ভাণ্ডারের বাড়ি এবং সেই বাড়িতে দুর্গাপূজা হয় বলে এরকম নাম। সেই বাড়িতে ডাকাতি করে এই লোকগুলো চলে গেল। জীবনের সেই প্রথম এবং এখনও অবধি শেষ আমার জ্যান্ত ডাকাত দেখা। কর্ণজোড়া পার্ক ছাড়িয়ে যে-রাস্তাটা গ্রামের দিকে ঢুকে যাচ্ছে, সেই রাস্তায় একটি ডাকাত-কালীবাড়ি আছে। বড়ো হয়ে সেই কালীবাড়ি দেখেছি। শুনেছি, সেখানে ডাকাতরা ডাকাতি করতে যাবার আগে পুজো দিত। তবে মুখোমুখি ডাকাত আমি কখনও আর দেখিনি। ভৌমিকদের ট্রাঙ্কের দোকান এখনও আছে। ভাগাভাগি হয়ে গেছে সম্পত্তি। 

শ্বেতাদি যখন ক্লাস ফোরে, ওর বাবা তখন সুইসাইড করেছিলেন। কাকার ফ্যামিলিতে ওরা তিন ভাইবোন মানুষ। এই শ্বেতাদির কথা একটু বলি। এই শ্বেতাদি এখন আমার কলিগ। কলেজে ছিল আমার বরের ক্লাসমেট। প্রাইমারিতে থাকাকালীন আমি তখন ক্লাস ওয়ানে পড়ি হয়তো। আমরা পরীক্ষা দিচ্ছি বার্ষিক। রামবাবু গার্ড দিচ্ছেন। আমি লেখা শেষ করে দিব্যি গুনগুনিয়ে গান ধরেছি। রামবাবু চিৎকার করছেন, "এই কে রে ?'"শ্বেতাদি বেশ ভালোই জানতো, আমিই সেই কালপ্রিট। কিন্তু দিব্যি অম্লানবদনে বললো, "কেউ না স্যার!"
ছবিতে অধুনা ঘড়িমোড়। বাঁদিকে ট্রাঙ্কের দোকান।
(ক্রমশ)

Comments