সমরেন্দ্র মণ্ডল

সেদিন অর্বাচীন ভাবছিল। বসে-বসে ভাবছিল, দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ভাবছিল, হাঁটতে-হাঁটতে ভাবছিল, চুল টানতে-টানতে ভাবছিল, নাকে সুড়সুড়ি দিতে-দিতে ভাবছিল—আরে হলোটা কী! এই যে কার্তিক মাস পড়ে গেল, দু'কলি হেমন্তর গান গাইবো, তা আর গাইতে দিচ্ছে কই! এখনও তো বর্ষার গানই শেষ হলো না! এই সময় তার তো মঞ্চে থাকার কথাই নয়। তবুও আছে। কী করে আছে, তা সবাই জানে। এই দেখুন না, বইয়ে যেমন লেখা ছিল, পাতা মিলিয়ে শরৎবাবু মঞ্চে ঢুকে সবে সংলাপ বলতে শুরু করেছেন, অমনি "আবার আসিয়াছি ফিরিয়া" বলে পাগলা দাশু-র মতো মঞ্চে ঢুকে এলোমেলো কাণ্ড করে বসলো। শরৎবাবু তো কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে মঞ্চের এক পাশে জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলেন। পরিচালক বললেন, আপনি এখন গড়গড়ায় তামাক টানুন।

ওদিকে বর্ষা সারা মঞ্চ জুড়ে গান গেয়ে, নেচে, ঝুড়ি-ঝুড়ি মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে দাপিয়ে বেড়াতে লাগলো। দর্শক বিরক্ত, ক্ষিপ্ত, ক্ষুব্ধ; পারলে এখনই  মঞ্চ থেকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়, কিন্তু ওই যে বইয়ের পাতা আর পরিচালকের আদর। তাতেই বছর-বছর রয়ে যাচ্ছে। মাঝেমাঝে অবশ্য দর্শক হুঙ্কার ছাড়ে, ভাগো, ভাগো হিঁয়াসে। কিন্তু ভাগাবে কে? কোমরে শাড়ি জড়িয়ে ঝাঁটা হাতে বলে, তোদের আস্পদ্দা তো কম নয়, আমাকে ভাগতে বলিস? আমার চোদ্দোগুষ্টিকে নিয়ে রাজত্ব করবো, যতদিন খুশি করবো, তাতে তোদের কী? বেশি ট্যান্ডাইম্যান্ডাই করলে বড়দাকে দিয়ে ঘাড় ধরে ওপারে চালান করে দোবো। হুঁ-হুঁ।

শরৎবাবু কী আর করেন, কিছুদিন ঘাপটি মেরে বসে থেকে চুপিচুপি সরে পড়েন। আর এই যে এত কাণ্ড ঘটে গেল, হেমন্তবাবু তার কিছুই টের পেলেন না। তিনি তো তখন গ্রিনরুমে বসে উদাসী বাউলের মেক-আপ নিচ্ছেন। মনে-মনে সংলাপ আওড়াচ্ছিলেন, দীপালিকায় আলো জ্বালতে হবে, শিশিরকে ডাকতে হবে, শিউলিকে ডাকতে হবে।
এসব যখন ভাবছেন, তখনই পরিচালকের নির্দেশ, ঠিক সময়ে ঢুকে পড়বেন।

হেমন্তবাবু যথাসময়ে, "আজি হেমন্তের ব্যাপ্ত চরাচরে/জনশূন্য ক্ষেত্র-মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে" গানটি গলায় ঝুলিয়ে মঞ্চে ঢুকে শিউলির দিকে পিটপিট করে তাকাচ্ছেন, তখনই ঝড় আর বাতাসকে সঙ্গে নিয়ে বর্ষা হামলা করলো। দনাদ্দন পেটো ঝাড়ছে। ভেঙে দিচ্ছে ঘরবাড়ি। ভাবখানা এমন, আমার রাজ্যে শান্তির গান গাইবি? মামদোবাজি!  ঝাঁটা দোবো, ঝাঁটা। আমার সঙ্গে পাঙ্গা নিতে আসবি না। মারাঠিদের গণেশ ঢুকিয়ে দিয়েচি, গুজুদের ধনতেরাস ঢুকিয়েচি, ঝাঁটা দিয়েচি, এবার কালীপুজোয় লবণও দিয়ে দিচি। হুঁ-হুঁ বাবা, আমি সব জানি। কোতায় কী হচ্চে, সব আমার জানা। আমার চোককে ফাঁকি দিয়ে শান্তি! শান্তি চাইবো আমি। তুই চাইবার কে রে? তোর শান্তির গুষ্টির ইয়ে করি।

হেমন্তবাবু দেখলেন, এ তো ভারী উপদ্রব হলো! এখন কী করবেন! তিনি পরিচালকের দিকে তাকিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলেন, কী করবো?
পরিচালক ইশারায় বললেন, বেরিয়ে যাও।
হেমন্তবাবু বেরিয়ে যেতেই তাঁর কানে-কানে বললেন, কিস্যু করার নেই ভাই। ও প্রযোজকের কোলের মেয়ে। প্রযোজকই ওকে গড়েপিটে মাঠে ছেড়ে দিয়েছে। চুপচাপ অপেক্ষা করো। ও এখনই গান লিখতে, কবিতা লিখতে, ছবি আঁকতে চলে যাবে। তখন তুমি মঞ্চে ঢুকে যেও।
—তখন যদি শীতের সময় হয়ে যায়?
—যাবে। তখন তুমি শীতের সঙ্গে শেষপাতার সংলাপ বলে প্রস্থান করবে।
—কিন্তু আবার যদি বর্ষা ফিরে আসে?
—না-আসারই কথা। তবে বাতিকগ্রস্ত মহিলা তো। বলা যায় না। মাঝেমধ্যে বিরক্ত করতে পারে। তবে চিন্তা নেই। ও সিবিআই, ইডি-র ভয় দেখিয়ে ঠিক ম্যানেজ করে নেবো।
—বড়দা যদি রাগ করে?
—আরে না-না। এতে বড়দার তহবিল বরং বাড়বে।
হেমন্তবাবু কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে শীতের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।

এ-পর্যন্ত ঠিকই ছিল। অর্বাচীনের ভাবনা অথবা স্বপ্নটা বেশ এগোচ্ছিল, হঠাৎই  পিছন থেকে কে যেন চুলে টান দিল। চমকে উঠে, প্রায় পড়ে যাওয়া থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে পিছন ঘুরতেই দ্যাখে জগা খ্যা-খ্যা করে হাসছে। অর্বাচীন রেগে কাঁই। একটা অশ্লীল শব্দ বলতে যাবে, অমন সময়ে জগা বলল, অত ভাবছেন কেন দাদা? এই ঝড়-বাদলের দিনে ফুলকপির খিচুড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ুন না।
—জগা-আ-আ-আ...
—রাগছেন কেন ভাই-ই? আগে তো আমিই অর্বাচীন ছিলুম। তা যখন বাতাস হয়ে গেলুম, তখন কী আর করি, আপনার ভিতরেই সেঁধিয়ে গেলেম। যদিও আপনি অর্বাচীন, তবুও জগা পাগলাকে ছাড়া তো নন। আপনিও যা জগা পাগলাও তাই। আর বাকি যা-কিছু হাওয়া-হাওয়া...ফুস...

Comments