২.
সময়ের সঙ্গে আবাস না-বদলালে অনেক স্মৃতি রয়ে যায়। সহজে গড়ে ওঠে না নতুন ভালোলাগা। পুরোনো স্মৃতির শহর পাকে-পাকে জড়িয়ে ধরে। জন্ম, কর্ম, বেড়ে ওঠা একঠাঁই হলে সবকিছুই কন্ঠস্থ তখন সেই শহরের। সেই শহর জানে সমস্ত বিচলন-মুহূর্ত। সমস্ত সাফল্য বোকামি ভয় ভুল পাপ। সেইসব স্মৃতি আর আমি অবসরে পাশাপাশি বসি। সুখ-দুঃখের কথা হয় চায়ের কাপ হাতে। বাড়লে বয়স আমার চুলে পাক ধরে। চামড়ায় ফাটল। স্মৃতিরা একদম ঝাঁ-চকচকে। স্মৃতিরা এখনও টগবগে তরুণ। তারা উচ্ছল কৈশোর। তারা টিন-এজ প্রেম। তারা ইনফ্যাচুয়েশান। এবং গোপন ক্রাশ। তাদের আজও কোনো বয়স বাড়েনি। পিটার প্যান। কত পুরোনো চিঠি যে হারিয়ে গেছে! প্রথম প্রেমের রক্তে লেখা চিঠিটাও। পুড়িয়ে ফেলেছি কৈশোরের গ্যাদগেদে আবেগি ডায়েরি। তারপরও প্রথম প্রেমের অলিগলি ঠিকানার স্মৃতি আমায় ছাড়ে না। যাদের জড়িয়ে আমার এসব স্মৃতি, হয়তো তাদের কোনো স্মৃতি নেই আমায় ঘিরে। আমিই শুধু-শুধু বসে আছি এক পুরোনো স্মৃতির শহর আঁকড়ে এই 'জেট সেট' দুনিয়ায়। নিতান্ত অকেজো। ব্যর্থ বুড়ো ভাম। বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে আরও বেশি স্মৃতিকাতরতার দিকে ঝুঁকছি যেন! হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর স্মৃতি আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরছি। আঁকড়ে ধরছি হারিয়ে যাওয়া সময়ের সুখস্মৃতি। এর থেকে মুক্তি নেই আর, যদি-না অ্যালঝাইমার এসে ভুলিয়ে দেয় সব।_______________________________________
আমি আজীবন সেই কুলিক পারের কন্যা। যতবার স্মৃতির চড়া সম্ভব না তারও বেশিবার প্লাবন। জলভরা মাসে নদীর পাড়ে মনখারাপের একলা বসে থাকা থেকে স্বর্ণযুগের হইচই পিকনিক। "বেলা যে পড়ে এল, জলকে চল্!" রক্তরঙা সূর্য ঢলে পড়লো জলে। সেই জলে চিকচিকালো কত অমলিন স্মৃতি। কুলিকজলে নেয়ে উঠে তর্পণ করি কত প্রিয়জনের। একআঁজলা জল নয়, সে আমার হৃদি বৃন্দাবন। কুলিকের আকাশি নীল শরৎ, তার শামুকখোল-পানকৌড়ির সংসার, তার দহনদিনের জারুল-শিমুল স্মৃতি, নদীর উপর সেই কবেকার নড়বড়ে এক ব্রিজ ফ্রিজশটে রেখে দেওয়া মনডায়েরিতে। শহর চিরে কালো অজগর এনএইচ ৩৪, গুমগুমে ধোঁয়া ওঠা কয়লার ইঞ্জিন, ন্যারোগেজ রেল, পিকনিক স্পট রাধিকাপুর, অল্প বেড়ানোর জায়গা কালিয়াগঞ্জ থেকে আজকের দু'খানা প্ল্যাটফর্ম আর গোটাদুই এক্সপ্রেস। সেই এক্সপ্রেসে কারা সব চলে যায় শহর ছেড়ে। আমি শুধু বসে-বসে দেখি। "সহে না যাতনা॥"
একজীবনের গল্পের উপর ভিড় জমায় দ্বিতীয়-তৃতীয় জীবনের গল্প। যেন আমার পুনর্জন্ম সব। এক-এক অবতারে ফিরে-ফিরে উপভোগ করা একটাই চলা। বাঁকে-বাঁকে রঙ। বাঁকে-বাঁকে ঢং। সময় শ্লথ করেছে এ-শরীর।সময় ছুঁতে পারেনি মন। আত্মা যেমন নাকি বেরিয়ে যায় শরীর ছেড়ে, আমার তেমন বেরিয়ে পড়ে মন। আমি জড়দ্গব বসে থাকি একখানে জবুথবু হয়ে, মন তখনও পাল্লা দিয়ে ছোটে বাতাসের সাথে হুজুগ-গলি। রোদে-জলে বিবর্ণ হয় খোলস। মনটি তখনও দুরন্ত প্রজাপতি। খানিক বিষণ্ণ, যেন-বা রোদ-বৃষ্টি রিমঝিম।
ছেড়ে যাওয়া অনেক বাড়ির একটি। মেয়ে বিদেশে থিতু হয়েছে। দেওয়ালে অযত্নের আগাছা। হয়তো বিক্রি হয়ে যাবে ক'দিন পরে।
____________________________________
পাড়া বেড়াতে গিয়ে মন আবিষ্কার করে, বদলে গেছে শহর। ভরে গেছে এককালের জলাভূমি। জোনাকির ঝোপ সাফ হয়ে, উঠে গেছে বাড়ি। ডাহুকের জলা খেয়ে ফেলেছে জমিহাঙরে। কোথাও চু-কিতকিত কাবাডি-কাবাডি মাঠ, জমি নেই। নেই সাইকেল শেখার মাঠটাও। আমিও বেতো হাঁটুতে ভুলেছি সাইকেল। কাটা পড়েছে মোড়ে-মোড়ে চেনা চেনা মহীরুহ। পুরোনো ল্যান্ডমার্ক। জাহাজবাড়ি, জজবাড়ি সব অতীত। এজমালি বাড়ি ভেঙে বিশাল-বিশাল আবাসন, তাতে রঙ আর ডিজাইনের বাহার। ভেতরের মাপ স্কোয়ার ফুটে। উঠোন গন। কমিউনিটি হল 'ইন থিং'। লাউমাচা গোয়ালঘর বইয়ের পাতায়। পুরোনো কত মানুষ শহর ছেড়েছে। পুরোনো কত মানুষ গ্ল্যামার হারিয়েছে সময়ের সাথে। হাতে লাঠি। কাঁধ কুঁজো। কখনো-কখনো পাই পরিচিতি মুখের মৃত্যুর খবর। অর্ধেক শহর নতুন মানুষে ভর্তি। বাকি অর্ধেকের অনেকেই তৃতীয় প্রজন্ম। কেউ-বা থাকলেও চলৎশক্তিহীন। অসুখ-অসুখ গন্ধ। কষ্ট হয় জেনে। জাঁকজমক বেড়েছে শহরের। নতুন মাল্টিপ্লেক্স। যে-সিনেমা হলগুলোতে একসময় কত গানবাজনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সিনেমা উৎসব দেখেছি; বন্ধ হয়েছে তারাও। অলিতে-গলিতে নতুন-নতুন দোকান। নতুন-নতুন আলোয় বিজ্ঞাপন ঢেকেছে রাস্তা। পুরোনো রাস্তার ওপর যেমন পড়ে নতুন পিচ; আমার তেমনি পুরোনো রাস্তা, গলির স্মৃতির উপর পড়ে নতুনের পরত। ছোটোবেলাকার চেনা দোকানপাট লোকেশান বদলে যায়। বদলে যায় মালিক-কর্মচারী। বদলে যায় ডাক এবং আমার ডাকনাম। আমাকে ডাকনামে ডাকার মতো খুব বেশি লোক আর নেই। স্মৃতিতে শুনি প্রিয় সেই ডাকগুলো। স্মৃতিতে ভাসে প্রিয় সেই ভয়েস। "ঐ মহাসিন্ধুর ওপার থেকে" আসা ডাকে আমি এক নিশি পাওয়া প্রাণ গোলকধাঁধায় যেন ঘুরে বেড়াই। আমৃত্যু বেড়াবো। আমার স্মৃতির খানিক ট্রান্সফার হবে আমার সন্তানে, বাকিটা আমার সঙ্গে মিশে যাবে পঞ্চভূতে।
(ক্রমশ)
Comments
Post a Comment