হেমন্তের শেষবেলায় শীত পড়তে-না-পড়তেই এদিক-ওদিক গজিয়ে উঠেছে জয়নগরের মোয়ার দোকান। দোকানে-দোকানে খেজুর গুড়, পাটালি আর নলেন গুড়ের মিষ্টি। অর্বাচীন একটা মোয়ার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে হরেক কিসিমের খেজুর গুড়ের মিষ্টি দেখতে-দেখতে ভাবছিল, দু'দিন আগেও এখানে পরোটা, ঘুগনি, আলুর দম, চা বিক্রি হচ্ছিল। সে বেশ কয়েকবার চা পান করেছে এখানে। আজও এসেছিল চায়ে চুমুক দিতে। তা কোথায় চায়ের দোকান? রাতারাতি ভোল পাল্টে হয়ে গেল জয়নগরের মোয়ার দোকান! ভ্যালা রে ভ্যালা। এ যে লাগ ভেল্কি লাগ!
এ তো জবরদস্ত ম্যাজিক মশাই। শুধু দোকান নয়, দোকানদার পর্যন্ত বদলে গেছে!
অর্বাচীন ভাবছিল, একটা ছোটোমাপের পাটালি কিনলে কেমন হয়! বেশ গোল-গোল। অনেকটা বাটির মতো দেখতে। কাচের ভিতর দিয়ে দেখতে-দেখতে চোখদুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো। পরক্ষণেই মনে হলো, গুড় যেন একটু বেশি চকোলেট রঙের! সে ধন্দে পড়ে গেল। মনে পড়লো, খুব ছোটোতে দাদুকে দেখেছিল গুড় জ্বাল দিতে। সবটা মনে নেই, তবে এটুকু মনে আছে, বড়ো কড়াইয়ে খেজুর রস জ্বাল দেওয়া হতো। দাদু মাঝেমাঝেই একটা পাটকাঠি রসে চুবিয়ে দেখে নিত, কতটা ঘন হলো। রস ঘন হয়ে লালচে রঙ ধরলেই মাটির থালায়, মাটির বাটিতে (যাকে মুচি বলতো) ঢেলে দিত। গুড়ের রঙ হতো চকোলেটের কাছাকাছি, কিন্তু চকোলেট নয়। আর এ যে দেখছি ক্যাডবেরির মতো। গুড়ের রঙ এমন হবে কেন?
মাথার মধ্যে একদিস্তা প্রশ্ন নিয়ে অর্বাচীন যখন লাট খাচ্ছে, তখনই কে যেন পিছন থেকে বললো— ভেজাল, ভেজাল।
সে পিছনে না-ফিরেই জিজ্ঞেস করলো, মানে?
—মানে সোজা। খেজুর গুড়ের সঙ্গে চিনি বা ভেলি মিশিয়ে দিয়েছে।
সে পিছনে না-ফিরেই জিজ্ঞেস করলো, মানে?
—মানে সোজা। খেজুর গুড়ের সঙ্গে চিনি বা ভেলি মিশিয়ে দিয়েছে।
—কিন্তু গুড়ের গন্ধ, স্বাদ সবই তো একরকম থাকে!
—ওখানেই তো হাতযশ মশাই! তবে গন্ধ এক থাকলেও স্বাদ কিন্তু গোলমেলে।
—গুড় তো খেজুর রসের। রস তো গাছেই...
—ওই, ওই ওখেনেই হিসেবের গড়মিল।
—মানে?
—মানে, গুড়ের চাহিদা বাড়ছে, খেজুর গাছ কমছে। এই যে দেখুন, আপনার আশেপাশের এলাকায় বা গ্রামে আগের মতো খেজুর গাছ দেখতে পান? পাবেন না। তার উপর গাছি, মানে ওই আপনারা যাদের শিউলি বলেন, এই গাছিও কমে গেছে। তাদের ছেলেরা অন্য পেশায় চলে গেছে।অনেকে মরে হেজে গেছে। খেজুর গাছ পোয়াতি হলে গাছি খুঁজে বেড়াতে হয়। তাহলে গাছ চাঁচবে কে? গাছ নেই, শিউলি নেই, রসের যোগান হবে কী করে? অথচ চাহিদা বাড়ছে। তাহলে সমাধান? চাহিদা ঠিক রাখতে ভেজাল মেশাও।
অর্বাচীন বড্ড বিরক্ত হলো। সে ঝাঁঝিয়ে উঠলো, অত হিসেব করে গুড় খাওয়া যায় নাকি?
—ওখানেই তো হাতযশ মশাই! তবে গন্ধ এক থাকলেও স্বাদ কিন্তু গোলমেলে।
—গুড় তো খেজুর রসের। রস তো গাছেই...
—ওই, ওই ওখেনেই হিসেবের গড়মিল।
—মানে?
—মানে, গুড়ের চাহিদা বাড়ছে, খেজুর গাছ কমছে। এই যে দেখুন, আপনার আশেপাশের এলাকায় বা গ্রামে আগের মতো খেজুর গাছ দেখতে পান? পাবেন না। তার উপর গাছি, মানে ওই আপনারা যাদের শিউলি বলেন, এই গাছিও কমে গেছে। তাদের ছেলেরা অন্য পেশায় চলে গেছে।অনেকে মরে হেজে গেছে। খেজুর গাছ পোয়াতি হলে গাছি খুঁজে বেড়াতে হয়। তাহলে গাছ চাঁচবে কে? গাছ নেই, শিউলি নেই, রসের যোগান হবে কী করে? অথচ চাহিদা বাড়ছে। তাহলে সমাধান? চাহিদা ঠিক রাখতে ভেজাল মেশাও।
অর্বাচীন বড্ড বিরক্ত হলো। সে ঝাঁঝিয়ে উঠলো, অত হিসেব করে গুড় খাওয়া যায় নাকি?
—রাগলে হবে দাদা? হিসেব না-করলে যে জীবনটাই বাজি রাখতে হবে। আর ওই যে দেখছেন লেখা রয়েছে নলেন গুড়। তা নলেন কী?
—কী? প্রশ্ন করেই ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্নকর্তাকে দেখতে গেল। কোথায় কে! সব ভোঁ-ভা। সে একা দাঁড়িয়ে। অর্বাচীন ভাবলো, লোকটা চলে গিয়েছে। যাক বাঁচা গেছে। সে দোকানের সামনে থেকে সরে এল। তখনই শুনলো, নলেন কী তা বুঝলেন না তো! ওই যে মশাই, খেজুর গাছের উপরের দিকে চেঁছে বাঁশের কঞ্চির নল লাগিয়ে দেয়। আর ওই নল বেয়ে রস ঝরে গাছে বেঁধে রাখা ভাঁড়ে। তার নাম নালান। এই নালান থেকেই নলেন। আরও একটা নাম আছে। তাতারস। এই রস থেকে পাতলা ঝোলের মতো যে গুড় হবে, সেটাই নলেন গুড়। এখন আপনি তেমন নলেন গুড় পাচ্ছেন কোথায়? সবই তো জ্বাল দিয়ে ঘন করে চিনি মিশিয়ে দিচ্ছে। প্রথম কাট থেকেই গুড় তৈরি শুরু করে দেয়।
—সারাদিনে রস তো মন্দ পড়ে না। তা গুড় বেশি হবে না কেন?
—না মশাই, দিনের বেলার রস মানে, যাকে ঝারা রস বলে, ও দিয়ে ভালো গুড় হবে না। তবে একটু গেঁজিয়ে নিলে ভালো তাড়ি হবে। মুড়ি আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে দুপুরের রোদে পিঠ এলিয়ে দিয়ে খেতে ভালোই লাগে। ভালো রস পাওয়া যায় রাতে। সন্ধের মুখে ভাঁড় বেঁধে দিল, এবার সারারাত রস ঝরো। সকালে আট-দশ লিটার রস পেয়ে গেলে। এবার জ্বাল দাও কি চোঁ+চোঁ করে চুমুক দাও। সে তোমার ইচ্ছে। তবে উৎকৃষ্ট রস কোনটা জানেন? জিরেন কাটের রস।
—কী? প্রশ্ন করেই ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্নকর্তাকে দেখতে গেল। কোথায় কে! সব ভোঁ-ভা। সে একা দাঁড়িয়ে। অর্বাচীন ভাবলো, লোকটা চলে গিয়েছে। যাক বাঁচা গেছে। সে দোকানের সামনে থেকে সরে এল। তখনই শুনলো, নলেন কী তা বুঝলেন না তো! ওই যে মশাই, খেজুর গাছের উপরের দিকে চেঁছে বাঁশের কঞ্চির নল লাগিয়ে দেয়। আর ওই নল বেয়ে রস ঝরে গাছে বেঁধে রাখা ভাঁড়ে। তার নাম নালান। এই নালান থেকেই নলেন। আরও একটা নাম আছে। তাতারস। এই রস থেকে পাতলা ঝোলের মতো যে গুড় হবে, সেটাই নলেন গুড়। এখন আপনি তেমন নলেন গুড় পাচ্ছেন কোথায়? সবই তো জ্বাল দিয়ে ঘন করে চিনি মিশিয়ে দিচ্ছে। প্রথম কাট থেকেই গুড় তৈরি শুরু করে দেয়।
—সারাদিনে রস তো মন্দ পড়ে না। তা গুড় বেশি হবে না কেন?
—না মশাই, দিনের বেলার রস মানে, যাকে ঝারা রস বলে, ও দিয়ে ভালো গুড় হবে না। তবে একটু গেঁজিয়ে নিলে ভালো তাড়ি হবে। মুড়ি আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে দুপুরের রোদে পিঠ এলিয়ে দিয়ে খেতে ভালোই লাগে। ভালো রস পাওয়া যায় রাতে। সন্ধের মুখে ভাঁড় বেঁধে দিল, এবার সারারাত রস ঝরো। সকালে আট-দশ লিটার রস পেয়ে গেলে। এবার জ্বাল দাও কি চোঁ+চোঁ করে চুমুক দাও। সে তোমার ইচ্ছে। তবে উৎকৃষ্ট রস কোনটা জানেন? জিরেন কাটের রস।
—জিরেন কাটের রস? মানে?
—গাছ দু-তিনদিন কাটার পর গাছকে তিনদিন জিরেন মানে বিশ্রাম দিতে হয়। তারপর গাছ কাটলে যে-রস পাওয়া যায়, সেটাই জিরেন কাটের রস। এখন এসব মানছে কোথায়!গাছ কাটার আগেই গুড় এসে হাজির বাজারে।
—গাছ দু-তিনদিন কাটার পর গাছকে তিনদিন জিরেন মানে বিশ্রাম দিতে হয়। তারপর গাছ কাটলে যে-রস পাওয়া যায়, সেটাই জিরেন কাটের রস। এখন এসব মানছে কোথায়!গাছ কাটার আগেই গুড় এসে হাজির বাজারে।
অর্বাচীন সেই অদৃশ্য কণ্ঠের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, তা কদ্দিন গাছ কাটা যায়?
—তা ওই জিরেন কাটের পর দিন তিনেক। তারপরেও অনেকে কাটে, কিন্তু তার কৌলিন্য ততদিনে নষ্ট হয়ে যায়। তবে শেষ কাটের রসও মন্দ নয়। খাবেন নাকি এক গেলাস?
অর্বাচীনের চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। জিভের জল সুড়ুৎ করে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তার কোথায় পাবো মশাই।
—আছে, আছে। খুঁজতে হবে। খুঁজুন, ঠিক পেয়ে যাবেন।
অর্বাচীন নিজেকেই বললো, থাক রস খাইয়া আর কাজ নাই।
—তা ওই জিরেন কাটের পর দিন তিনেক। তারপরেও অনেকে কাটে, কিন্তু তার কৌলিন্য ততদিনে নষ্ট হয়ে যায়। তবে শেষ কাটের রসও মন্দ নয়। খাবেন নাকি এক গেলাস?
অর্বাচীনের চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। জিভের জল সুড়ুৎ করে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তার কোথায় পাবো মশাই।
—আছে, আছে। খুঁজতে হবে। খুঁজুন, ঠিক পেয়ে যাবেন।
অর্বাচীন নিজেকেই বললো, থাক রস খাইয়া আর কাজ নাই।
Comments
Post a Comment