প্রাণেশ সরকার

পরের দিন সকালে মেজোকাকার (নীহাররঞ্জন সরকার ওরফে ফেলুবাবু) বাড়িতে গিয়ে মেজোকাকা, কাকিমা-কে প্রণাম। আবারও মণ্ডামিঠাই। মেজোকাকা আমাদের স্কুলের সেক্রেটারি ছিলেন বেশ কিছুদিন। ওঁর ছেলে অসীম আমাদের সহপাঠী ছিল। স্কুলজীবনের পরীক্ষার দিনগুলিতে অনেক-অনেকবার কখনও দিদিমা-র হাতে, কখনও মেজোকাকির হাতে ভাত খেয়ে তবে স্কুলে গিয়ে পরীক্ষা দিয়েছি। এই স্নেহ-ভালোবাসা কখনও ভুলবো না। অ্যানুয়াল পরীক্ষার মার্কশিট নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে মেজোকাকাকে নাম্বার দেখিয়ে আসতাম। উনি আমাকে নিয়ে প্রচ্ছন্ন এক গর্ববোধ করতেন। কারণ, আমি তাঁর পাড়ার ছেলে এবং হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান হয়েও পরীক্ষায় বরাবর ফার্স্ট হতাম। উনি প্রতি ক্লাসে আমাকে কিছু নতুন বই কিনে দিতেন। মুহুরিকে বলতেন, "শচীন ভৌমিকের দোকানে গিয়ে ও যে-বইগুলোর কথা বলবে, বুকলিস্ট মিলিয়ে বইগুলো ওকে কিনে দিন। বলুন, ফেলু সরকার পাঠিয়েছে। ওর কর্মচারী যেন আমার গদি থেকে বইয়ের দাম নিয়ে যায়।"


মেজোকাকার বড়োমেয়ে শেফালিদি-র বিয়ে হয়েছিল খুব ধুমধাম করে, শান্তিপুর-নিবাসী এক অধ্যাপকের সঙ্গে। নাম— টিকেন্দ্রজিৎ। খুব সুদর্শন যুবক। শেফালিদি কৃষ্ণবর্ণা, কিন্তু দেখতে-শুনতে ভালো। মেজোকাকা ধনী মানুষ। বাদকুল্লা বাজারে পাট ও ভুষিমালের আড়ত। দুটো লেল্যান্ড লরি। নিজের ব্যবহারের জন্য ফিয়াট গাড়ি। তাঁর বন্দুক ছিল। প্রসঙ্গত, তিনি নলিনীমোহন সরকারের প্রথম পক্ষের মেজোছেলে। বড়োছেলে কালী সরকার। তাঁর বাড়ি ছিল বাদকুল্লা কদমতলার নিকটবর্তী পোস্ট অফিস পাড়ায়। বাজারে তাঁর ধান-গম-তৈলবীজ ভাঙাবার বিশাল কলঘর। তাছাড়া তিনি রেশন ডিলার। যাইহোক, মেজোকাকা মেয়ের বিয়েতে দু'হাত উপুড় করে খরচ করেছিলেন। নহবত বসিয়েছিলেন। বর্ধমান থেকে সব বাজিগর এসেছিল। কী রঙবেরঙের বাজির আলোর রোশনাই বাড়ির চৌহদ্দি ও আশেপাশের এলাকাকে উৎসবমুখর ও বর্ণময় করে তুলেছিল। তিন-চারদিন ধরে খাওয়াদাওয়া চলেছিল। মাছ, মাংস, পোলাও, রাজ্যের বিভিন্নপ্রান্তের বিখ্যাত সব মিষ্টান্ন— সে এক এলাহি কাণ্ড! এসেছিল কলকাতার বিখ্যাত ব্যান্ডপার্টি। তাদের বাদ্যযন্ত্র সম্পূর্ণ আধুনিক। আর কী সব সুর তারা বাজিয়েছিল; আহা, এখনও কানে বাজে যেন!


শেফালিদি-র বিয়ের দিনেই জমিদার এবং বাদকুল্লা হাট ও বাজারের মালিক ভগবানচন্দ্র বিশ্বাসের মেয়ে সবিতাদি-র বিয়ে হয়েছিল, কৃষ্ণনগরের এক অ্যাডভোকেটের সঙ্গে। দূর থেকে সানাই শুনেছিলাম। সেখানেও নহবত বসেছিল। সেখানে আমাদের নিমন্ত্রণ ছিল না অবশ্য। এই পরিবারের সঙ্গে অনেক পরে আমার এক সংযোগ রচিত হয় প্রাইভেট টিউটর হিসাবে। ভগবান বিশ্বাসের ছেলে অজিত বিশ্বাসের একমাত্র কন্যা ইন্দ্রাণীকে বাড়ি গিয়ে অনেকদিন পড়িয়েছিলাম আমি। ইন্দ্রাণী এখনও আমাকে সেই 'কাকু' বলেই ডাকে। তার বিয়েতেও আমার কিছু দায়িত্ব ছিল। ইন্দ্রাণীর বাবা অজিত বিশ্বাসের বিয়ে হয়েছিল মুড়াগাছার খাঁ-পরিবারে। বৌদি ইন্দিরা অপরূপা সুন্দরী ছিলেন। আমরা তখন খুবই ছোটো। কেনা বললো, "প্রাণেশ, জমিদারবাড়ির নতুন বউ সোনার মুকুট পরে শীতলাতলায় জোড়ে প্রণাম করতে আসছে। চল, দেখে আসি।" গিয়েছিলাম দেখতে। পালকি থেকে নেমেছিলেন তিনি। সুন্দরী, সালঙ্কারা; সোনার মুকুট মাথায়, ঝলমল করছে বেনারসি শাড়ি। পরে যখন ইন্দ্রাণীকে পড়াই, বৌদি একদিন সিন্দুক খুলে আমাকে দেখিয়েছিলেন সেই স্বর্ণমুকুট। আমার দিদি সবিতাকে বৌদি ভালোবাসতেন খুব। 'সবিতাদি' বলে ডাকতেন। অমন হাসিখুশি অতিথিবৎসল বউ এ-দিগরে আর দ্বিতীয়টি দেখলাম না আমি।


এবার পুঁটি গয়লানির কথা বলবো। আগেই বলেছি, তিনি সেই পাঁচু ঘোষের দিদি, যাঁর বাড়িতে দুর্গোৎসব হতো। পুঁটি গয়লানি বড়ো একটা চকচকে পিতলের বালতিতে দুধ নিয়ে বাদকুল্লা বাজারের দু-একটি মিষ্টির দোকানে দিতেন— ভীম ময়রার দোকানে, কেষ্ট কুণ্ডুর দোকানে, ইত্যাদি। ধবধবে সাদা থান, গলায় মোটা সোনার চেন, সবক'টা আঙুলেই রত্নখচিত অঙ্গুরীয়, সামনের দুটো দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধানো, হাতে বেশ দামি কালো এক লাঠি— তার গিঁটগুলো সব রুপোর পাতে মোড়া। মৃদুমন্দ গতিতে দুধের বালতি নিয়ে বাজারে হেঁটে আসছেন তিনি, অহিফেন সেবনে ঢুলুঢুলু আঁখি— আহা, সে এক দৃশ্য যেন আরব্যোপন্যাস থেকে উঠে আসা! গম্ভীর মানুষ তিনি, তবে বাচ্চাদের ভালোবাসতেন। আমি স্কুলে পড়ি এবং প্রথম হই বলে, আমাকে একটু নেকনজরেই দেখতেন পুঁটি ম্যাডাম। হ্যাঁ, মনে-মনে তাঁকে আমি 'পুঁটি ম্যাডাম'-ই বলতাম। তাঁর বাড়ি যেতাম আমরা— পূর্ণেন্দু, কেনা ও আমি। কাঁসার কাঁধ-উঁচু থালায় ভেজানো চিড়ে, মুড়কি, শবরি কলা, চকচক দানাযুক্ত আখের গুড়, আর গরুর ঘন আঠালো গরম দুধ কোনো-কোনোদিন আমাদের খেতে দিতেন তিনি। পিসির প্রশস্ত পশ্চিমের বারান্দায় বসে সে-অমৃতফলারের সদব্যবহার করতাম আমরা, আর মনে পড়তো রবিঠাকুরের সেই মিষ্টিমধুর কবিতার কথা : 

"আমসত্ত্ব দুধে ফেলি,    তাহাতে কদলী দলি

সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে —

হাপুস হুপুস শব্দ    চারিদিক নিস্তব্ধ, 

পিঁপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।"

এত চেটেপুটে খেতাম সেই সুখাদ্য যে, সত্যিই কি পিঁপড়েদের জন্য কিছু অবশিষ্ট থাকতো থালায়!

কাঁসার এক বড়ো জামবাটিতে জ্বাল দেওয়া ক্ষীরের মতো ঘন দুধে আফিমের গুঁড়ো মিশিয়ে অনেকবারই তাঁকে খেতে দেখেছি। একদিন তাকিয়ে আছি দেখে পিসি বললেন, "ওষুধ খাচ্ছি রে, ওষুধ।"


বাল্যকালের বন্ধু কেনা, মহাদেব আর পূর্ণেন্দুর কথা তো আগেই বলেছি। এবার হাইস্কুলের বন্ধুদের কথা বলবো। তাদের মধ্যে পূর্ণেন্দু তো ছিলই; আরও ছিল দীপেন সরকার, বিকাশ মৈত্র, বিপ্লব ভট্টাচার্য, বিপ্রদাস মুখার্জি, অপরেশ মুখার্জি, প্রবীর দাস, প্রবীর মিত্র (বিধু), অসীম সরকার, অশোক সরকার, অশোক দাশগুপ্ত, বিকাশ মজুমদার, বিকাশ রায়, শিবানন্দ রায়, প্রিয়মোহন দেবনাথ, আশিস বসু, সুজিত সরকার, শ্যামাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, মোহনলাল দাস ব্রহ্মচারী, প্রণব বিশ্বাস, অলোক বিশ্বাস, প্রমুখ। এদের মধ্যে অশোক দাশগুপ্ত এবং বিকাশ মজুমদার বীরনগর থেকে আমাদের স্কুলে সায়েন্স পড়তে এসেছিল। সেই সময়ে, ১৯৬৭ সালে, বীরনগর স্কুলে সায়েন্স ছিল না। বাকি সবাই বাদকুল্লার বাসিন্দা। দীপেন মেধাবী ছাত্র ছিল। ও কমার্স স্ট্রিম নিয়ে পড়াশোনা করলো। ব্যাঙ্কের অফিসার হয়েছিল। রাঁচিতে বাড়ি করে থিতু হয়েছে। দীপেনদের বাড়ি গাংনিতে। বাবা ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ওর বড়দা জীবেন সরকার চিত্রশিল্পী ছিলেন, দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টে কাজ করতেন। মেজদা শিবেন সরকার বাদকুল্লা ইউনাইটেড একাডেমিতেই গণিতের শিক্ষক হয়েছিলেন। আর, ওদের ছোটোভাই অজয় খুবই মেধাবী। প্রেসিডেন্সি ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে যথাক্রমে অনার্স ও মাস্টার্স করে, নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজে অধ্যাপনা করতো। আত্মহননের পথ বেছে নিয়ে ছেলেটি অকালে ঝরে যায়। দীপেন ক্লাস ফাইভ থেকে ইলেভেন পর্যন্ত আমাদের ভাঙাচোরা কুঁড়েঘরে আসতো। মা ওকে আর আমাকে বাটিতে মুড়ি খেতে দিতেন। এই বুড়োবয়সেও ও সেই গল্প করে! বিকাশ (মৈত্র)-ও দীপেনের মতোই আসতো আমাদের বাড়ি। আমিও বিকাশদের বাড়ি যেতাম। মাসিমা কিছু-না-কিছু খাবার দিতেনই। ওর দিদি ও বোনেরা ছিল লেখাপড়ায় বেশ ভালো। মেসোমশায় কলকাতার ছাপাখানায় কম্পোজিটরের কাজ করতেন। খুব কষ্টে সংসার চালাতে হতো মাসিমাকে। আমাদের কলেজ-জীবনেই (বিকাশ রানাঘাট কলেজে বাংলা অনার্স পড়তো আর আমি ইংরেজি অনার্স পড়তাম কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজে) বিকাশের বাবা বাড়ির আমগাছের উঁচু ডালে উদবন্ধনে আত্মহত্যা করেছিলেন। খুবই হৃদয়বিদারক ঘটনা। বিএ পাস করে বিকাশ ভাগ্যানুসন্ধানে কলকাতায় গিয়ে শিক্ষকতার কাজ করতো আর সান্ধ্যবিভাগে এমএ পড়তো। কলকাতা থেকে এসে, কাঁচড়াপাড়া স্কুলে কিছুদিন সহকারী প্রধানশিক্ষক থেকে পরবর্তীতে চাকদহের নিকটবর্তী বালিয়ায় সে প্রধানশিক্ষক হয়। কৃতী ছাত্র, শিক্ষক, সর্বোপরি একজন উচ্চমানের প্রাবন্ধিক ও কবি। ওর লেখা বেশকিছু বই আছে। এখনও আমাদের বন্ধুত্ব অটুট। যেমন, দীপেন সেই রাঁচি থেকে এখনও ফোনে আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছে। বাদকুল্লা রেলস্টেশনে যখন ফুটব্রিজ হলো, আমরা তখন দশম শ্রেণিতে বোধহয়। আমি, দীপেন আর বিকাশ প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় সেই ফুটব্রিজে উঠে গল্প করতাম। কখনো-বা আমরা চলে যেতাম আড়বান্দিতে, বিপ্রদাস মুখার্জির বাড়িতে। বিপ্রদাসের ঠাকুরদা রামগোপাল মুখোপাধ্যায় আমাদের স্কুলের সেক্রেটারি ছিলেন দীর্ঘদিন। বিপ্রদাস ও অপরেশ তুতো ভাই। ওদের উপনয়নে আমরা বন্ধুরা খুব খেয়েছিলাম, অবশ্যই আমন্ত্রিত হয়ে। ইলিশ ও রুই—দু'ধরনের মাছই ছিল। আমি গোটা দশেক রুই ও সাত-আটপিস ইলিশ খেয়েছিলাম। তারপর দই, মিষ্টি তো ছিলই। আমি একা নই, আমরা সবাই-ই কম-বেশি এরকমই খেয়েছিলাম। রামগোপালবাবু সামনে বসে খাইয়েছিলেন। আড়বান্দির জমিদার বলে কথা! বিপ্রদাস এখন কলকাতায় আছে। অপরেশ কল্যাণীতে। জমিদারবাড়িতে কেউ আর থাকে না অবশ্য। খণ্ডহর হয়ে পড়ে রয়েছে। বিপ্লব ভট্টাচার্যও খুব ভালো বন্ধু ছিল আমার। আর বিপ্লবের বোন শীলা (চানা) ছিল আমার বোন টুনু (প্রতিমা)-র বন্ধু। বিপ্লবদের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সেই বিপ্লবও এখন বিপত্নীক অবস্থায় কলকাতাতেই রয়েছে। আমার সঙ্গে যোগাযোগ আছে এখনও। এ-প্রসঙ্গে একটা কথা বলি। আমরা যারা ১৯৬৯ সালে বাদকুল্লা ইউনাইটেড একাডেমি থেকে হায়ার সেকেন্ডারি পাস করেছিলাম, তারা ১৫-১৬ জন মিলে বছরে একটা দিন (সাধারণত শীতকালে) কখনও বীরনগরে অশোক দাশগুপ্তের বাগানবাড়িতে বা বাদকুল্লায় বিকাশ মৈত্র-র বাড়িতে মিলিত হই। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ সবাই একসঙ্গে খাই। স্মৃতিচারণ, গান, কবিতাপাঠ চলে সারাদিন। একবার বিকাশ মজুমদার সস্ত্রীক এসেছে, আর অশোকের স্ত্রী তো থাকেই। সে একবার আমাদের দুধকচুবাটা খাইয়েছিল, মুখে এখনও লেগে আছে। কলকাতা থেকে প্রিয়মোহন দেবনাথ, কান্তি ব্যানার্জি, বিপ্লব ভট্টাচার্য ও বিকাশ মজুমদার সামিল হয় এই আনন্দমুখর গেট-টুগেদারে। কোভিড মহামারীর কারণে মাঝে বন্ধ ছিল এই উৎসব। দীপেন তো রাঁচিতে থাকে। ও আর কী করে আসবে! তবুও ওর আসার খুব ইচ্ছে; এই সেদিনও ফোনে আমাকে বলছিল সেকথা। প্রিয়মোহনের মেয়ের বিয়েতেও দমদমে কান্তির সঙ্গে দেখা হয়েছিল। এখন সে অসুস্থ; আর আসতে পারে না আমাদের বাৎসরিক মিলনোৎসবে। 


নিতাই ঘোষ-ও আমার স্কুলের বন্ধু। ওর মেয়ে নিরুপমা আমার ছাত্রী ছিল। সে এখন নার্স। ওর স্বামী ডাক্তার। নিতাই, প্রিয়মোহন ও আমি ২০১৭ সালে জানুয়ারিতে ত্রিপুরায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। আগেরদিন রাতে প্রিয়-র বাড়িতে থাকলাম। পরেরদিন বেলা ১১টায় আমাদের ফ্লাইট। প্রিয়মোহনের স্ত্রীর আন্তরিক আতিথেয়তা মুগ্ধ করেছিল আমাদের। ত্রিপুরায় প্রথমে আগরতলা শহরেই নিতাইয়ের দূরসম্পর্কের ভাইয়ের বাড়িতে অতিথি হলাম আমরা। ধনী ব্যক্তি, স্বর্ণব্যবসায়ী। তাঁর স্ত্রী ও দুটো বাচ্চা। সুবিশাল দুর্গোপম বসতবাড়ি ভদ্রলোকের। খুব যত্নে রেখেছিলেন উনি। নিজের গাড়ি করে আগরতলার কিছু দ্রষ্টব্যস্থান তিনি দেখিয়েছিলেন আমাদের। ত্রিপুরার রাজপ্রাসাদ এখন মিউজিয়াম। মিউজিয়ামটি মুগ্ধ করেছিল আমাকে। আর গেলাম পুরোনো আগরতলায় বিধ্বস্ত রাজপ্রাসাদ ও চোদ্দো দেবতার মন্দির। ভদ্রলোক ও তাঁর পরিবারকে বিদায় জানিয়ে পরেরদিন আমরা একটা গাড়ি ভাড়া করে উদয়পুরের উদ্দেশে রওনা দিলাম। উদয়পুরের পথে আমরা গেলাম নীরমহলে। রুদ্রসাগর লেকের ওপারে এই নীরমহল। ত্রিপুরার শেষ মহারাজা বীরবিক্রম কিশোরমাণিক্য গ্রীষ্মাবাস রূপে তৈরি করিয়েছিলেন এই জলপ্রাসাদ ভবন। নীরমহল নামটি রবীন্দ্রনাথের দেওয়া। অতীতের এই ভবন ধ্বংসের মুখে আজ। পাড় থেকে নৌকো করে আমরা গিয়েছিলাম নীরমহলে। এবার আমাদের গন্তব্য উদয়পুর। উদয়পুরে নিতাইয়ের এক বোনের বাড়ি। তাঁর বাড়িতেই পৌঁছলাম আমরা। বেলা তখন আড়াইটে। প্রচণ্ড ঠান্ডা। স্নান করেই বেরিয়েছিলাম আগরতলা থেকে। হাত-পা ধুয়ে আমরা খেতে বসে গেলাম ডাইনিং-এ। সবকিছু গরম-গরম পরিবেশন করলেন ভদ্রমহিলা। বিকালে আমরা সবাই মিলে মাতাবাড়ি (ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দির) গেলাম। অনুচ্চ টিলার উপর মায়ের মন্দির। চারচালা শৈলিতে নির্মিত। একান্ন পীঠের এক পীঠ। সতীর দক্ষিণ পদ পতনের স্থান। নিতাইয়ের বোন পুজো দিলেন। আমরা সবাই প্রসাদ পেলাম। মা-কে প্রণাম করে বাড়ি এলাম। খুব ঠান্ডা এখানে। রাতে খাওয়াদাওয়া সেরে, লেপেকম্বলে একঘুমে রাত কাবার। পরেরদিন  সকাল-সকাল স্নানাহার সেরে বেরিয়ে আগরতলা। দুপুরের ফ্লাইটে আগরতলা থেকে দমদম। দমদম থেকে ট্রেন ধরে নিতাই আর আমি বাড়ি ফিরলাম। আমার জীবনে এই প্রথম বিমানভ্রমণ। বেশ উপভোগ করেছিলাম। দমদম এয়ারপোর্টে সন্ধ্যায় নামার আগে আলোকোজ্জ্বল মহানগরীকে রূপকথার জনপদ মনে হচ্ছিল। ফেরার সময়ে, কী সৌভাগ্য, জানালার পাশে সিট পেয়েছিলাম! কিছুদিন পরে এই অভিজ্ঞতা থেকে নিম্নোক্ত কবিতাটি লিখেছিলাম। কবি ও সম্পাদক শ্যামলকান্তি দাশ কবিসম্মেলন  সাহিত্যপত্রে কবিতাটি প্রকাশ করেছিলেন।

উড়ান
শ্বেত কপোতের মতো বিশুদ্ধ বিমান আমাকে ধারণ করে
আমাকে উড়ান দেয় উত্তর-পূর্বের এক শহরের দিকে। ঘনঘোর
ভুরুপল্লবে অয়ি সব লাবণ্যময়ী সপ্রতিভ সেবিকার অ্যাপ্রন-ঝড়ে
কিঞ্চিৎ বেসামাল দু-একটি তরুণ কায়মনোবাক্যে জপে প্রণয়ের ভোর।
জানালায় চোখ রাখি, ভাসমান মেঘের পালক পরম পুলকে আজ
যন্ত্র-পক্ষীটিকে অনুকূল সাহচর্য দেয়, বক্ষে স্থাপন করে সারি সারি যাত্রীর দল
যারা সব উজ্জ্বল উড়ানের ঝোঁকে আবেশে বিহ্বল কত কারুকাজ
মনে মনে গেঁথে নেয়, আর গেঁথে নিয়ে অনুভব করে শুধু জীবনের জল
স্রোত হয়ে অবিমিশ্র তরঙ্গ হয়ে কীভাবে জাপটে ধরে কাঙ্ক্ষার ডালি
কীভাবে উৎসারণ মননে ও বোধে সম্পৃক্ত হয়ে থাকে বিটপীতে লতার মতন
কীভাবে স্রোতোরাশি উত্তাল, সংক্ষুব্ধ, মায়াময়, আর সপাটে গ্রাস করে বালি
দূরে ওই তটরেখা জুড়ে উদ্দাম জীবনের পাশে লেখা থাকে মৃত্যুর সমন।

কালচক্র যত্ন করে এ সমস্ত ঘটিয়ে চলে নিরবধিকাল
জল দিয়ে ধুলো দিয়ে একে একে এইসব লিখে রাখি কালের রাখাল।


বাদকুল্লা বাজারের দু-একজন দোকানদারের কথা বলবো এ-প্রসঙ্গে। একজন ভীম ময়রা। আড়বান্দির মানুষ। বংশপরম্পরায় ময়রা তিনি, মোদক। বয়স্ক মানুষ, খর্বাকৃতি, স্থূলকায়। তাঁর মিষ্টির দোকানটি ছিল বেশ বড়ো। চারপাশে দরমার বেড়া। উপরে শনের ছাউনি। বাজারে ঢুকতেই তাঁর দোকান। তাঁর ছেলেরা ও মিষ্টি বানানোর কারিগরও দোকান পরিচালনায় সাহায্য করতো তাঁকে। মনে আছে, খুব বড়ো-বড়ো রাজভোগ ও পান্তোয়া বানাতেন তিনি। তাছাড়া জিলিপি, বোঁদে, নিমকি, সিঙারা, কাঁচাগোল্লা, লবঙ্গলতিকা ইত্যাদি মিষ্টি ও নোনতার খুবই চাহিদা ছিল বাজারে। আমার বিবেচনায় ভীম মোদকের মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের শ্রেষ্ঠ প্রোডাক্ট ছিল জিবেগজা। এত খাস্তা ও মিহি সেই সুস্বাদু গজা, জিভে দিলেই যেন গলে যেত। আমি মিষ্টির রসিক বরাবর। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে নানাধরনের মিষ্টান্ন খেয়েছি; কিন্তু ওই জিবেগজা আর কোথাও পেলাম না! ভীম মোদককে আমি জেঠু বলতাম। বড়ো হয়ে, হাইস্কুলের ছাত্রকালীন সময়পর্বে, ওঁর দোকানে কখনো-কখনো দু-চার পয়সার মিষ্টি কিনে খেয়েছি। কিন্তু ওঁকে বস্তুত মনে রেখেছি একটি কারণে, তা হলো এই যে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পোড়ো যখন আমরা, বাড়ি ফেরার পথে ওঁর দোকানের কাছে এসে আমার আর কেনা-র, কখনো-বা পূর্ণেন্দুর জলতেষ্টা অবশ্যই পেত; কারণ, মাটিতে গেঁড়ে বসানো বিশাল কালো জালা থেকে বাঁশের হ্যান্ডেল লাগানো স্টিলের ছোটো মগে করে কর্মচারী আমাদের জল দিত আর জলের আগে একটা করে বড়ো ছানার মুড়কি দিত। বাচ্চাদের জল দেওয়ার সময় একটা করে ছানার মুড়কি দিতেই হবে— এই ছিল দোকানের কর্মচারীর প্রতি ভীমজেঠুর নির্দেশ। অন্যথা হলে, তার কপালে কষ্ট ছিল। ফোকলা দাঁতের জেঠু তড়বড় করে কী তাকে বলতেন, তা বোধগম্য না-হলেও এটা বুঝতাম যে, ওটা ভর্ৎসনা। হ্যাঁ, ছানার মুড়কির কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। ওটাও ছিল ওঁর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের স্পেশালিটি।

এবার বলবো হলাসা-র চপের দোকানের কথা। আসল নাম তার হলধর সাহা। লোকে বলতো 'হলাসা'। চমৎকার সব চপ বানাতেন তিনি। স্পেশালিটি ছিল আলুর চপ আর ফুলুরি। মুড়ির সঙ্গে কাঁচালঙ্কা-সহ এই চপ তিনি বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিক্রি করতেন। ভীম মোদকের দোকানের প্রায় লাগোয়া ছোট্ট এই দোকানটি ছিল আসলে একটি টঙ। হলাসা-র মেয়েরাও চপ বিক্রিতে বাবাকে সাহায্য করতো। হলাসা-র ছেলে আমাদের সিনিয়র ছিল হাইস্কুলে। পড়াশোনায় ভালো। পরে তিনি সরকারি চাকরিও পান। গাংনিতে, অঞ্জনা নদীর দক্ষিণে, প্রায় নদীর উপরেই ছিল কালোরঙের একটা একতলা বাড়ি। সেখানেই থাকতেন ওঁরা। হলাসা-কে মাঝেমধ্যেই পুলিশ গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যেত। দোকান থেকেই নিয়ে যেত। আমিও চাক্ষুষ করেছি ঘটনাটি। শুনেছি, তিনি নাকি কাগজের ছোটো-ছোটো পুরিয়ায় গাঁজা বিক্রি করতেন লুকিয়েচুরিয়ে। আর এই অভিযোগেই পুলিশের হানা। তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর মেয়েরাই দোকান চালাতো। ক'দিন পরে আবার তিনি পুলিশ হেফাজত থেকে ফিরে বহাল তবিয়তেই চপের দোকান চালাতেন। কিছুদিন পরে আবার পুলিশ হানা দিত দোকানে। তাঁকে গ্রেফতার করতো। আবার তিনি ফিরেও আসতেন। এটা যেন একটা রুটিন অ্যাফেয়ার হয়ে গিয়েছিল! সত্যিই আমার বাল্যকালে হলাসা ছিলেন একটা ক্যারেক্টার।

আমি ছোটোবেলা থেকে প্রথম যৌবন পর্যন্ত দেখেছি, বাদকুল্লা বাজার এলাকায় দিশি মদ, তাড়ি এবং গাঁজার খুব কদর আছে একশ্রেণির মানুষের কাছে। দিশি মদ বা তাড়িতে রসাসক্ত হয়ে খাসি-কাটা মাংসের কারবারি নীলু হাড়ি বা অভিজাত বাড়ির ছেলে হাজু ব্যানার্জি-ই শুধু বাজার এলাকায় মাতলামি করতো না, অন্য অনেকেই করতো; কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই ছিল। খুব একটা বড়ো সামাজিক সংকট এতে ঘটতো না। আর এখন তো লাইসেন্সড লিকার শপ-ই খুলে গেছে এই জনপদে—সেটা কিন্তু অনেকক্ষেত্রে সংকট তৈরি করছে। সরকার আবগারি শুল্ক ভালোই পাচ্ছে, কিন্তু অনেক তরুণ ও তাদের সংসার শেষ হয়ে যাচ্ছে। 

দুর্গাপুজোর সময়ে বাজারে কোথাও-কোথাও জুয়োর বোর্ড বসতো। অনেক বাবু জুয়ো খেলতো। বাজারে দোকানদারি করতাম বলে এবং বাজারের কাছেই আমাদের বাড়ি হওয়ায়, এসব তথ্য আমার কাছে ছিল। মাঝেমাঝে পুলিশ জুয়োর বোর্ডে হানা দিয়ে বোর্ডের টাকা ও দু-একজন জুয়াড়িকে তুলে নিয়ে যেত। পুলিশ চলে গেলেই, অন্য কোনো জায়গায় আবার বোর্ড বসতো। পরেরদিনই দেখতাম, যাদের পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল তারা বহাল তবিয়তে ফিরে এসে পান চিবুতে-চিবুতে বাজার করছে। বোর্ডের টাকা সরকারি কোষাগারে জমা পড়তো কিনা, তা অবশ্য বলতে পারবো না! 


মনোরঞ্জনের আরও সব বিষয় ছিল দুর্গাপূজা বা বড়োপুজোকে কেন্দ্র করে। যেমন, যাত্রাপালার আসর বসতো বাজারের টিনের শেডযুক্ত বিশাল হাটচালায়। ব্যবসায়ী সমিতির সিরাজদ্দৌলা পালা বিখ্যাত ছিল। ফেলুবাবু সিরাজের ভূমিকায় চমৎকার অভিনয় করতেন। যাত্রাপালা শুরু হতো রাত ১১টা-১২টায়। শুরু হওয়ার আগে তিন-তিনবার কনসার্টের বাজনা। দর্শকরা কনসার্ট শুনেই হাতে হ্যারিকেন নিয়ে ছুটতো যাত্রার আসরে। কনসার্টের পরে নৃত্য। নারীবেশী পুরুষেরাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে নর্তকী হতেন। চমৎকার নাচতেন তাঁরা; আর সঙ্গে কী বাজনা, আহা! মূল পালাগানে পুরুষেরাই নারীচরিত্রে অভিনয় করতেন। মা-র কোল ঘেঁষে আমি আর আমার বোন টুনু কত যাত্রা দেখেছি। নবাব সিরাজদ্দৌলা, রাজা হরিশচন্দ্র, মেবার পতন, চন্দ্রগুপ্ত, সোনাই দিঘি, আরও কত যাত্রাপালা! ক্লান্তিতে ঘুমিয়েই পড়তাম যাত্রা দেখতে-দেখতে। ঘুমের ঘোরেই মা-কে বলতাম, "যখন তরবারি-যুদ্ধ হবে, আমাকে ডেকে দিও।" প্রায়ই ভোররাতে শেষ হতো যাত্রাপালা। মা-কে ধরে ঘুমে ঢুলতে-ঢুলতে বাড়ি যেতাম। টানা ঘুম দিয়ে, স্নান-খাওয়া সেরে স্কুলে যেতাম।

স্থানীয় দল যেমন অভিনয় করতো, চিৎপুরের নামী যাত্রাদলও বাদকুল্লায় প্রচুর যাত্রা করেছে। তৎকালের বিখ্যাত নট ছোটো ফণী সিরাজদ্দৌলা পালায় সিরাজের ভূমিকায় অভিনয় করে গেছেন। অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে কেউ-কেউ "এনকোর, এনকোর" বলে চিৎকার করে উঠেছে। কেউ-বা শিল্পীদের গলায় সোনা বা রুপোর মেডেল ঝুলিয়ে দিয়েছে। কেউ আবার পাঁচটাকা-দশটাকার কাগজের নোটও সেফটিপিন দিয়ে বুকে সেঁটে দিয়ে এসেছে। এরই সঙ্গে প্রচুর হাততালি, হর্ষধ্বনি। একটু বড়ো হলে আমরা অনামী বা গাংনির মাঠে বীণা দাশগুপ্ত, শান্তিগোপাল, অমর মিত্র প্রমুখ বিখ্যাত নট-নটীদের পালাগানও টিকিট কেটে দেখেছি। দিল্লি চলো, লেনিন, হিটলার, রাজা রামমোহন, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শের আফগান, উৎপল দত্তের ফেরারি ফৌজ— আরও কত যাত্রাপালা! শান্তিগোপাল তো রাশিয়া গিয়ে লেনিন, হিটলার-ও করে এসেছেন এবং সেখানে উচ্চপ্রশংসিত হয়েছেন। বাদকুল্লায় বরাবরই যাত্রার ঐতিহ্য আছে। পরবর্তীতে অনেক চলচ্চিত্রকুশলী যাত্রায় নেমেছেন। তাঁদের দু-একজনের যাত্রা দেখেছি, কিন্তু ভালো লাগেনি। যাত্রায় অভিনয় করা কঠিন। এখানে চারপাশ খোলা মঞ্চ, চারপাশেই দর্শকমণ্ডলী। কাজটা সত্যিই কঠিন! সোনাই দিঘি যাত্রাপালার খলচরিত্র ভাবনাকাজীর ভুমিকায় নটসম্রাট দিলীপ চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় এখনও চোখে লেগে আছে। 

বড়োপুজো উপলক্ষে বাদকুল্লায় পুতুলখেলা, ম্যাজিক শো ছোটোখাটো সার্কাস শো-ও হতো। বগুলার পুতুলখেলা ছিল ভারতবিখ্যাত। ম্যাজিকে দেখতাম, একটা লোক জল খেয়েই চলেছে, তারপর নাক-মুখ দিয়ে সেই জল ফোয়ারার মতো বের করে দিচ্ছে। সার্কাসে রোমহষর্ক দুটি খেলা জীবনে ভুলবো না। একটা হচ্ছে, লোহার বড়ো গোলকের মধ্যে মোটরসাইকেল চালানো; আর অন্যটি হলো, কাঠের বোর্ডে একটা মেয়ে সার্কাসের কস্টিউম পরে দাঁড়িয়ে আছে আর দূর থেকে চোখে কালো কাপড় বাঁধা একটা লোক একটার পর একটা তীক্ষ্ণ ছুরি পরপর মেয়েটার কানের পাশে, মাথার একটু উপরে, দুই বগলের নিচে, দুই উরুর ফাঁকে ছুঁড়ে দিচ্ছে— একটাও গায়ে লাগছে না! শিউরে উঠছি আমরা দর্শকমণ্ডলী আর ভাবছি, একটু এদিক-ওদিক হলেই তো সেই ছুরি একেবারে মাখনের মতো গেঁথে যাবে মেয়েটার শরীরে। ওফ, সে তো রক্তারক্তি কাণ্ড হবে! যাক, ভাগ্যিস কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি!


তখন সবে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হয়েছি। এক শনিবার স্কুল থেকে ফিরে ভাত খেয়ে মাটির বারান্দায় খেজুরপাতার পাটিতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। শুনি, মাইকে একটা গান ভেসে আসছে। খুব দূর থেকে নয়। কী গান? "জল ভরো কাঞ্চনকন্যা জলে দিয়া মন"। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। চোখেমুখে জল দিয়ে মাইকের আওয়াজ লক্ষ করে এগিয়ে চলি বাদকুল্লা ধানহাটের ওপারে দিগনগর রোডের ওপাশে। দেখি, বিশাল এক মাইকের চোঙ; চোঙ থেকে কী জোরে " ম্যায় আওয়ারা হুঁ...", "ঝনক ঝনক পায়েল বাজে...", "জল ভরো কাঞ্চনকইন্যা..." ইত্যাদি হিন্দি ও বাংলা গান পরপর তারস্বরে বেজে চলেছে। এক গোডাউনের মতো হলঘর, তার মুখে লেখা 'শ্রীমা টকীজ'। পরে জেনেছি, হাঁসখালির কে এক দেবু ঘোষ ওই সিনেমাহলের মালিক। সেদিনই উদ্বোধন। প্রথম ছবি নীলাচলে মহাপ্রভু । চৈতন্যদেবের ভূমিকায় অসীমকুমার। প্রথম শো চারটেয়, বিনা পয়সায়। একদৌড়ে বাড়ি এসে মা-কে বলে, আবার একদৌড়ে সরাসরি হলের ভিতরে। বাঁশের খুঁটির উপর কাঠের তক্তা— এই হচ্ছে দর্শকাসন। যাইহোক, মাঝামাঝি একটা জায়গায় বসে পড়লাম। ও মা, আমার দু-তিন রো পরে দেখি মহাদেব ও কেনা! পূর্ণেন্দু নিশ্চয়ই খবর পায়নি। শো তো শুরু হলো বলে। কে আর তাকে খবর দেবে! পরে বলা যাবে ওকে। সিনেমা শুরু হলো। ঘটনাচক্রে নিমাই সন্ন্যাস নিয়ে চলে যাচ্ছেন। গান হচ্ছে— "বিষ্ণুপ্রিয়া গো, তুমি থাকো ঘুমঘোরে, আমি চলে যাই..."। বাঁ-পাশে মহিলাদের সিট, তাঁদের কান্নার ফ্যাচফ্যাচ শব্দ কানে আসছে; বিষ্ণুপ্রিয়ার দুঃখে কাতর মহিলাকূল। হাফটাইম। ভিতরে বক্সে গান হচ্ছে। মালিক-কর্তৃপক্ষ হলে উপস্থিত সব দর্শককে একটুকরো করে বড়ুয়া কেক দিচ্ছে। বিনা পয়সায়। টিকিট ফ্রি, কেক ফ্রি। বাঃ রে ভাই, বেড়ে মজা তো! কেক খেয়ে, জল খেয়ে আবার হলে, নির্দিষ্ট আসনে। কাহিনি তরতর করে এগিয়ে চলেছে। "হা কৃষ্ণ, হা জগন্নাথ" বলতে-বলতে দু'বাহু উপরে তুলে গলায় ফুলের মালা, বাবরি চুল, সুদর্শন অসীমকুমার থুড়ি চৈতন্যদেব পুরীর সমুদ্রগর্ভে চলে যাচ্ছেন। "দি এন্ড" ভেসে উঠলো পর্দায়।
(ক্রমশ)



★ এই লেখার আগের অংশ পড়তে হলে, নিচের দুটি লিঙ্কে দেখুন :

প্রথম পর্ব
https://www.muktadhara.co.in/2023/08/blog-post_73.html
দ্বিতীয় পর্ব
https://www.muktadhara.co.in/2023/09/blog-post_22.html


Comments